শেখ হাসিনাকে বারবার হত্যার চেষ্টা, সৌভাগ্য ছিল সহযাত্রী

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। সময় বিকেল ৫টা ৪০ মিনিট। স্থান আওয়ামী লীগ অফিসের সামনের সড়ক, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। মাত্রই শেষ হলো হলো দলীয় সমাবেশ। খোলা ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেওয়া শেষ করলেন সেই সময়ের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। সমাবেশস্থলে ট্রাকের চারপাশে তখনো কয়েক হাজার কর্মী-সমর্থকের ভিড়।

ট্রাকের শেষ মাথায় মই লাগানো। নামার জন্য সেদিকে এগিয়ে গেলেন শেখ হাসিনা। তারপর যা ঘটল, তা বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে নৃশংস ও নিকৃষ্টতম অধ্যায়। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো গ্রেনেড। একটি নয়, একের পর এক বিস্ফোরিত হতে থাকল গ্রেনেড। এতটা দ্রুত একটির পর একটি বিস্ফোরণ সম্ভবত যুদ্ধক্ষেত্রেও কদাচ দেখা যায়। বিস্ফোরণের শব্দ যখন থামল, তখন বোঝা গেল, এ কেবল নিছক শব্দ নয়, এ ছিল নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। দেখা গেল গ্রেনেডের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়া মানুষের দেহ এবং তার ওপর দিয়ে জ্ঞানশূন্য মানুষের দিশেহারাভাবে ছুটে চলা। ক্ষমতায় তখন বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার।

ঘাতকেরা যাঁকে হত্যার জন্য নারকীয় এই আয়োজন করেছিল, সেই শেখ হাসিনা কিন্তু প্রাণে বেঁচে গেলেন অলৌকিকভাবে। সে দিন শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে তাঁকে ঘিরে মানবপ্রাচীর সৃষ্টি করেছিলেন ঢাকার প্রয়াত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ, প্রয়াত নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী মায়াসহ দলের আরও একাধিক শীর্ষ নেতা।

সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। ছবি: জিয়া ইসলাম
সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। ছবি: জিয়া ইসলাম

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াল এই হামলা প্রাণ কেড়ে নেয় ২২ জনের। তাঁদের মধ্যে ছিলেন তখনকার মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমান। এর বাইরে গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে ক্ষতবিক্ষত হন কয়েক শ নেতা-কর্মী, যার যন্ত্রণা তাঁরা এখনো বয়ে চলেছেন। স্প্লিন্টারের যন্ত্রণার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতেই ঘটনার দেড় বছর পর মারা যান মোহাম্মদ হানিফ। গ্রেনেডের বিকট শব্দে ক্ষতিগ্রস্ত কানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এখনো ব্যবহার করতে হয় ‘হিয়ারিং এইড’।

মামলা ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা জোট সরকারের
বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ তখন বধ্যভূমি, এদিক-ওদিক পড়ে আছে মানুষের ছিন্নভিন্ন অঙ্গ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতালসহ আরও অনেক হাসপাতালে শোনা যাচ্ছিল আহত আর অর্ধমৃত মানুষের আর্তনাদ এবং স্বজনদের আহাজারি। ওই অবস্থাতেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মামলা দিতে গেলে পুলিশ সে মামলা নেয়নি। তার আগেই পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করে।

ঘটনার সময় সংসদের অধিবেশন মুলতবি ছিল। ১২ সেপ্টেম্বর সংসদ বসলে আওয়ামী লীগের নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রক্তমাখা পাঞ্জাবি পরে অধিবেশনে যোগ দেন। সে দিন তিনি সংসদে এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে স্পিকার জমির উদ্দিন সরকার তাঁকে ফ্লোর দেননি। তবে সাংসদ আইভি রহমানের মৃত্যুতে নিয়ম অনুযায়ী শোকপ্রস্তাব গৃহীত হয়।

সেই সময় সরকার মামলাটির সঠিক তদন্ত না করে উল্টো তা ভিন্ন দিকে নেওয়ার অপচেষ্টা করে। নোয়াখালীর সেনবাগের একটি গ্রাম থেকে জজ মিয়া নামের এক যুবককে ধরে নিয়ে এসে আদালতে মিথ্যা জবানবন্দি আদায় করে। এতে জজ মিয়া নিজেকে ঘটনার অন্যতম পরিকল্পনাকারী বলে দাবি করেন।
পরে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে মামলাটির নতুন করে তদন্ত শুরু করে। তাতেই একের পর এক বেরিয়ে আসতে থাকে চাঞ্চল্যকর তথ্য। অবসান হয় জজ মিয়া নাটকের।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পুলিশ নতুন করে তদন্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়। তাতে বিএনপির নেতা তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ আরও অনেক ব্যক্তি জড়িত আছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
সম্প্রতি নিম্ন আদালত এই মালার শুনানি শেষ করেছেন। বর্তমানে শেষ আসামি বাবরের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক চলছে। এরপর যেকোনো সময় আদালত এই মামলার রায় ঘোষণা করতে পারেন।

রোববার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গণমাধ্যমকে বলেছেন, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে মামলার রায় পাওয়া যাবে বলে তাঁরা আশা প্রকাশ করছেন।
সোমবার আইনমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, মামলার শেষ আসামির পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক চলছে। সুতরাং ধরে নেওয়া যায় মামলার বিচারকাজ অচিরেই শেষ হবে। এরপর রায় কখন ঘোষণা করা হবে, সেটা পুরোপুরি আদালতের এখতিয়ার।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য এর আগেও একাধিকবার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল ঘাতকেরা। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে সেসব পরিকল্পনা এবং প্রতিবারই সৌভাগ্য ছিল তাঁর সহযাত্রী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যা করা হয়, তখনো সৌভাগ্যক্রমে দেশে ছিলেন না শেখ হাসিনা।

হত্যার চেষ্টা কোটালীপাড়ায়
হুজি-বির অন্যতম শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নান ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডার বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন। এরপর তিনি আদালতে দুই দফায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে শেখ হাসিনার ওপর বিভিন্ন হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের বিবরণ দেন।

মুফতি হান্নানের জবানবন্দি অনুযায়ী, ২০০০ সালের জুলাই মাসে হুজি-বির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে শেখ হাসিনাকে হত্যার সিদ্ধান্ত হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ওই বছরের ২০ জুলাই কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার সমাবেশস্থল ও হেলিপ্যাডের কাছে দুটি শক্তিশালী বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল। তবে সমাবেশের আগে পুলিশ তা উদ্ধার করে ফেলে।

গত বছরের ২০ আগস্ট আদালত ওই ঘটনায় করা দুটি মামলার রায় ঘোষণা করেন। তাতে আদালত ১০ জনের ফাঁসি এবং আরও ১৩ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন। দণ্ডপ্রাপ্ত সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (হুজি-বি) নেতা-কর্মী।
তবে এই মামলার প্রধান পরিকল্পনাকারী মুফতি হান্নানকে আদালত অপর একটি মামলাতেও (ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর বোমা হামলা) ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত করেন। গত বছরের ১২ এপ্রিল ওই দণ্ড কার্যকর করা হয়।

হত্যার চেষ্টা সিলেটে
২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটে নির্বাচনী জনসভায় বোমা পুঁতে রেখে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল হুজি-বি। তখন ক্ষমতায় ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু হামলার আগেই জনসভাস্থলের অদূরে বোমা বিস্ফোরণে জঙ্গিদের দুই সদস্য নিহত হওয়ায় জঙ্গিদের পরিকল্পনা ভন্ডুল হয়ে যায়। ওই ঘটনায় মামলা হলেও শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনার কথা শুরুতে জানা যায়নি।
২০০৬ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি মাদ্রাসা থেকে মুফতি হান্নানের ‘গুরুখ্যাত’ জঙ্গিনেতা মাওলানা আবু সাইদ ওরফে আবু জাফরকে গ্রেপ্তারের পর বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। আবু সাইদ ২০০৬ সালের ৫ অক্টোবর সিলেট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জবানবন্দি দিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার কথা স্বীকার করেন।

ব্যর্থ হয় খুলনার পরিকল্পনা
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা যায়, এর আগে ২০০১ সালের ৩০ মে খুলনায় রূপসা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল হুজি-বি। অনুষ্ঠানের তিন দিন আগে ২৭ মে সেতুর কাছাকাছি রূপসা নদীতে দুটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ১৫ জঙ্গি ধরা পড়ে যাওয়ায় সেটিও আর সফল হয়নি। এই ১৫ জনের একজন মাসুম বিল্লাহ ওরফে মুফতি মইন ঢাকায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় অংশ নিয়েছিলেন।
নৌকা থেকে গ্রেপ্তার হওয়া এই ১৫ জন মুফতি হান্নানের নেতৃত্বাধীন হুজির সদস্য ছিলেন।

চট্টগ্রাম গণহত্যা
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার জনসভা বানচাল করতে পুলিশের গুলিতে ২৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হন। এটি পরে চট্টগ্রাম গণহত্যা নামে পরিচিতি পায়। সেদিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। ঘটনার ৪ বছর পর ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ আইনজীবী শহীদুল হুদা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে চট্টগ্রামের সাবেক পুলিশ কমিশনার রকিবুল হুদাসহ ৪৬ জনকে আসামি করে মামলা করেন।


ব্যর্থ হয় ফ্রিডম পার্টি
জঙ্গিদেরও আগে ১৯৮৯-এর ১১ আগস্ট রাতে ফ্রিডম পার্টির একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে গুলিবর্ষণ ও গ্রেনেড হামলা চালায়। ওই হামলাও শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা ছিল, এ অভিযোগে ঢাকার ধানমন্ডি থানায় দুটি মামলা হয় তখন। মামলা দুটির বিচারকাজ এখনো শেষ হয়নি।
সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ও কর্নেল বজলুর রশীদের নেতৃত্বে ফ্রিডম পার্টি গঠিত হয়েছিল।


যাঁরা নিহত হন
আওয়ামী লীগের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। পরে সব মিলিয়ে নিহত মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ২২ জনে। নিহত ব্যক্তিরা হলেন—আইভি রহমান, ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রহমান (শেখ হাসিনার দেহরক্ষী), হাসিনা মমতাজ, রিজিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম, রতন শিকদার, মোহাম্মদ হানিফ, মোশতাক আহমেদ, লিটন মুনশি, আবদুল কুদ্দুছ পাটোয়ারী, বিল্লাল হোসেন, আব্বাছ উদ্দিন শিকদার, আতিক সরকার, মামুন মৃধা, নাসিরউদ্দিন, আবুল কাসেম, আবুল কালাম আজাদ, আবদুর রহিম, আমিনুল ইসলাম, জাহেদ আলী, মোতালেব ও সুফিয়া বেগম।