আদালতের মতামতের জন্য অপেক্ষা

ছবি: হাসান রাজা
ছবি: হাসান রাজা

সরকারি কমিটি বিদ্যমান চাকরি কোটা তুলে দেওয়ার পক্ষে বললেও ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়টি নির্ভর করছে আদালতের মতামতের ওপর। কারণ, এ বিষয়ে রায় থাকায় উচ্চ আদালতের মতামত নেওয়া হবে।

এদিকে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটার বিষয়ে মতামত দিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল। গতকাল সোমবার বিকেলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তাঁর কার্যালয়ে গিয়ে মতামত নিয়ে যান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘আমি রায় ও বিভিন্ন সিদ্ধান্তের আলোকে মতামত দিয়েছি। এখন সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।’ তবে তিনি কী মতামত দিয়েছেন, তা বলতে রাজি হননি।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, একাধিক রিট মামলার রায়ে উচ্চ আদালত মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। কোথাও পর্যবেক্ষণ, কোথাও নির্দেশনা দিয়েছেন। মামলা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, আইন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা ও একজন আইনজীবী প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ অন্যান্য কোটা সরকার চালু করেছে। এটা স্বাধীনতার পর থেকেই হয়ে আসছে। আদালতের মতামত চাইলেও এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে হবে সরকারের পক্ষ থেকে।

বর্তমানে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৫৫ শতাংশ অগ্রাধিকার কোটায় (৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা কোটা ও ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিসত্তা কোটা) নিয়োগের বিধান আছে। বাকি ৪৫ শতাংশ নিয়োগ হয় মেধার ভিত্তিতে। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে পোষ্য, আনসার-ভিডিপিসহ আরও কিছু কোটা রয়েছে।

সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন। আন্দোলনের একপর্যায়ে গত ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন। কিন্তু প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা আবার আন্দোলন শুরু করলে একপর্যায়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা-মামলার ঘটনা ঘটে। এরপর ২ জুলাই সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি পর্যালোচনা, সংস্কার বা বাতিলের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের সচিবদের নিয়ে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে সরকার। ১৩ আগস্ট কমিটির প্রধান ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, তাঁদের মোটামুটি সুপারিশ হলো বিদ্যমান কোটার প্রায় পুরোটাই তুলে দেওয়া এবং মেধাকে প্রাধান্য দেওয়া। আর ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়ে উচ্চ আদালতের রায় থাকায় এ বিষয়ে আদালতের মতামত চাওয়া হবে।

কী আছে আদালতের রায়ে
আদালত সূত্র এবং রিটকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা ও খাদ্য অধিদপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পরিচালক জামাল উদ্দিন শিকদার ২০১২ সালে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন সরকারের দেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স-সংক্রান্ত একটি বিষয়ে। ওই আবেদনে বলা হয়, ২০১১ সালে সব সরকারি চাকরিজীবীদের অবসরের বয়স ৫৭ থেকে ৫৯ করা হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কথা স্বীকার করে সরকার মুক্তিযোদ্ধা চাকরিজীবীদের অবসরে যাওয়ার বয়স আগেই ৫৯ করেছিল। কিন্তু এখন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ সুবিধাটি আর থাকল না। রিটে ‘সরকারি কর্মচারী অবসর সংশোধিত আইন, ২০১১’ চ্যালেঞ্জ করা হয়।

এই রিটের শুনানির সময় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরের বয়স ৫৯ থেকে বাড়িয়ে ৬০ করেছে। ২০১২ সালের ৫ ডিসেম্বর হাইকোর্ট কিছু পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা দিয়ে রিটটি নিষ্পত্তি করেন। এই রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত ৩০ শতাংশ চাকরির কোটা কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। আর কোনো ক্ষেত্রে কোটা পূরণ করা সম্ভব না হলে ২০১০ সালে করা এ-সংক্রান্ত আরেকটি রিটের নির্দেশনা অনুযায়ী পদ খালি রাখতে হবে।

পরে এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। ২০১৫ সালের আগস্টে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের কিছু বিষয় বাদ দিয়ে আপিলের রায় দেন। তাতে ‘কোনো ক্ষেত্রে কোটা (মুক্তিযোদ্ধা কোটা) যদি পূরণ করা সম্ভব না হয়, সে ক্ষেত্রে পদ খালি রাখতে হবে’ অংশসহ কিছু বিষয় বাদ দেন আপিল বিভাগ। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এর মানে হলো মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে শূন্য পদ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করার সুযোগ আছে, যেটা এখন সরকার করছে। কিন্তু ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা রয়েই গেছে।

রায়ের পর্যবেক্ষণ মানা বাধ্য কি না, জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, রায় দেখে মতামত দেবেন তিনি।

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, কোটা একেবারেই বাতিল হোক, তাঁরা সেটা চান না। তাঁরা সব সময়ই বলে আসছেন, কোটার যৌক্তিক সংস্কার হোক।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, জামালউদ্দিন শিকদারের করা রিটের শুনানিতে প্রাসঙ্গিকভাবে আগে করা একটি রিটের তথ্যও উঠে আসে। তাতে খাদ্য অধিদপ্তরের কয়েকটি পদে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পূরণ না হওয়ায় প্রতিকার চান কয়েকজন। সেই রিটেও মুক্তিযোদ্ধা কোটা পূরণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। ২০১০ সালের ওই রিটের রায়ে বলা হয়,...আবেদনকারীর দাবি, নিয়োগপ্রক্রিয়ায় ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা অনুসরণ করা হচ্ছে না। আদালত বলেন, কোনো সন্দেহ নেই যে একটি নীতি আছে, যেখানে নিয়োগপ্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তানসন্ততির জন্য ৩০ শতাংশ কোটা অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে। কিন্তু এই মামলার দলিলাদি প্রমাণ করে, ওই নীতি অনুসরণ করা হয়নি। রায়ে আবেদনকারী সাতজনকে নিয়োগ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

এই রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের রায় হয় ২০১৪ সালে। তাতে সরকারকে হাইকোর্টের রায় অবিলম্বে বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয় এবং সরকার যাতে কোনো অজুহাত না করে, তারও নির্দেশ দেওয়া হয়।

জামাল উদ্দিন শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, রিটটি করার সময় তিনি চাকরিতে ছিলেন। রায় যখন হয়, তখন অবসর-উত্তর ছুটিতে (পিআরএল) ছিলেন। আদালত পিআরএল ভোগরত ব্যক্তিদেরও সুবিধা দিতে বলেন। কিন্তু সরকার সেটা না মানায় তিনি আদালত অবমাননার মামলার করেছেন, যেটা এখনো চলছে।