'আমারে ইস্তিরি দিয়া ছ্যাঁকা দিত, গরম পানি ঢালত'

হাসপাতালের বিছানায় বেগম। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ২১ আগস্ট। ছবি: কামরান পারভেজ
হাসপাতালের বিছানায় বেগম। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ২১ আগস্ট। ছবি: কামরান পারভেজ

‘আমার গায়ে তিনি গরম ইস্তিরি দিয়া ছ্যাঁকা দিত, গরম পানি ঢালত। কথায় কথায় লাঠি দিয়া মুখে মারত। রাইতে সাহেব (গৃহকর্তা) বাসায় আসলে আমারে বাথরুমে আটকাইয়া রাখত।’


আজ মঙ্গলবার দুপুরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিছানায় চিকিৎসাধীন মোছা. বেগম (২২) খুব নিস্তেজ কণ্ঠে এভাবে তাঁর ওপর চালানো নির্যাতনের বর্ণনা দেন।

বেগম রাজধানীর পোস্তগোলা এলাকার একটি বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করতেন। সেখানে তিনি টানা আড়াই মাস ধরে নির্যাতনের শিকার হন বলে অভিযোগ করেন। নির্যাতনের অভিযোগে গত শনিবার রাতে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ থানায় তিনি একটি মামলা করেন। মামলায় নির্যাতনের অভিযোগে গৃহকর্ত্রী ও তাঁর স্বামীসহ মোট ছয়জনকে আসামি করা হয়েছে বলে ঈশ্বরগঞ্জ থানা-পুলিশ জানায়।

বেগম ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মাইজবাগ ইউনিয়নের রাওলের চর গ্রামের মো. শামছুদ্দিনের মেয়ে। আট মাস আগে স্বামী তাঁকে ছেড়ে যায়। পরে তিনি জীবিকার সন্ধানে এলাকার এক নারীর সহায়তায় ঢাকায় গিয়ে বিভিন্ন বাসায় কাজ শুরু করেন।

আজ মঙ্গলবার দুপুরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি জানান, দীর্ঘদিন ধরেই তিনি রাজধানীতে বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করতেন। পোস্তগোলা এলাকায় তিনি ভাড়া থাকতেন। প্রায় আড়াই মাস আগে এক নারীর মাধ্যমে পোস্তগোলা এলাকার একটি বাড়িতে কাজ নেন। কাজ শুরু করার পর থেকে সামান্য ভুল হলেই গৃহকর্ত্রী তাঁকে মারধর, গরম ইস্তিরি দিয়ে ছ্যাঁকা ও গমর পানি গায়ে ঢেলে দিতেন। গৃহকর্তা রাতে বাড়ি ফিরতেন। মারধরের বিষয়টি স্বামীর কাছে আড়াল করার জন্য স্বামী ফেরার পর তাঁকে (বেগম) বাথরুমে আটকে রাখা হতো। দিনের পর দিন এভাবে নির্যাতনের পর তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে গত শনিবার গৃহকর্ত্রী তাঁকে মহাখালী এনে ময়মনসিংহের বাসে তুলে দেন।

বেগমের ভগ্নিপতি মো. আবুল হাসেম বলেন, বাসচালক ময়মনসিংহে পৌঁছানোর পর তাঁকে (হাসেম) ফোন করে অসুস্থ বেগমের বাড়ির ঠিকানা জানতে চান। পরে তিনি ঠিকানা জানিয়ে বাসের চালককে অনুরোধ করেন, বেগমকে যেন কিশোরগঞ্জগামী একটি বাসে তুলে দিয়ে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের বটতলা বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দিতে বলে দেন। গভীর রাতে বেগমকে ওই বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দিলে সিএনজিচালিত অটোরিকশার এক চালক তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যান। নির্যাতনের শিকার বেগম ঠিকমতো কথা বলতে পারছিলেন না। তাঁর সারা শরীরে নির্যাতনের অনেক ক্ষত চিহ্ন।

দগদগে ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন বেগম। ছবি: সংগৃহীত
দগদগে ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন বেগম। ছবি: সংগৃহীত

শনিবার রাতেই বেগমকে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। এরপর গতকাল সোমবার ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। বেগমের মুখ ও চোখের নিচে মারধরের অনেক চিহ্ন। শরীরের বিভিন্ন স্থানে, পিঠে ও ঊরুতে ইস্ত্রির ছ্যাঁকা ও গমর পানির পোড়া দাগ আছে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করে।

বেগম বলেন, ‘আমি ওই বাসার ঠিকানা বলতে পারব না। তবে পোস্তগোলায় একটি মোড় আছে। সেখান থেকে একটা গলি গেছে। ওই গলি দিয়ে আমি বাসায় যেতে পারব। আমি বিচার চাই। আপনারা আমারে নিয়া চলেন। আমি বাসা চিনি।’

চিকিৎসাধীন বেগমের পাশে থাকা তাঁর বৃদ্ধা মা মোছা. রুমেলা বলেন, ‘আমার মেয়েরে যারা মারছে, আমি তাদের বিচার চাই। মেয়েটার সারা শরীরে মাইরের দাগ। ’

হাসপাতালে কর্মরত একজন নার্স নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সারা শরীরে যে পরিমাণ মারের ক্ষত রয়েছে, তাতে সুস্থ হতে অনেক সময় লাগবে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঈশ্বরগঞ্জ থানার উপরিদর্শক (এসআই ) শাওন চক্রবর্তী বলেন, ‘বেগম যেভাবে ঠিকানা বলছেন, এতে আসামির ঠিকানায় পৌঁছানো সম্ভব নয়। আমরা ওই বাড়িটি শনাক্ত করতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। বেগম কিছুটা সুস্থ হলে আমরা তাঁর কাছ থেকে আরও ভালোভাবে ঠিকানা বুঝে অথবা তাঁকে সঙ্গে নিয়ে আসামিকে গ্রেপ্তার করতে যাব।’