বিএনপির ঘাঁটিতে আ.লীগের দাপট

আসনটি বিএনপির ‘দুর্গ’ হিসেবে পরিচিত। তবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখানে জাতীয় পার্টি থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ নির্বাচিত হন মোহাম্মদ নোমান। শুরু থেকেই তাঁর সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের বনিবনা নেই। এই জোট থেকে এবার আসনটিতে মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন ৯ জন।

অন্যদিকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী তিনজন। অথচ বিগত নির্বাচনগুলোতে এখানে বিএনপির  প্রার্থী ছিলেন দুই ডজনের বেশি। কোন্দল এড়াতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে নিজেই প্রার্থী হন এই আসন থেকে।


আওয়ামী লীগের হালহকিকত

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল থেকে মনোনয়ন পান কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক হারুনুর রশিদ। এ মনোনয়নের বিরুদ্ধে ছিলেন স্থানীয় নেতা–কর্মীরা। তাঁরা যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ আলী খোকনের পক্ষে অবস্থান নেন। মোহাম্মদ আলী বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় দল। হেরে গিয়ে রাগে-ক্ষোভে হারুনুর রশিদ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর চার বছর এলাকায় যাননি। তবে এবারও নির্বাচনী মাঠে আছেন তিনি।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এহ্সানুল কবির (জগলুল) প্রথমে মনোনয়ন পান। পরে দলের অনুরোধে তিনি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। জোটের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পার্টি থেকে মোহাম্মদ নোমান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ নির্বাচিত হন। রায়পুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল খোকনের ভাষ্য, শুরু থেকে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব দেখা দেয়। টিআর, কাবিখাসহ বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়।

ওই নির্বাচনের পর এহ্সানুল কবির আবার রাজনীতির মাঠ নিজ অনুকূলে নিয়ে আসেন। নেতা–কর্মীদের একটা বড় অংশ তাঁর পক্ষে রয়েছে।

২০১৭ সালের জুলাই মাসে এনআরবি ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শহিদ ইসলাম (পাপুল) রায়পুরে রাজনীতির মাঠে হঠাৎ আবির্ভূত হন। গত ১৭ ডিসেম্বর হেলিকপ্টারে রায়পুরে গিয়ে দুস্থদের মধ্যে বিপুলসংখ্যক কম্বল বিতরণ করেন। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ দলের ২৫ নেতা-কর্মীকে মোটরসাইকেল দিয়ে কাছে টেনে নেন। দলের রায়পুর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল খোকনও তাঁর পক্ষে অবস্থান নেন।

সব মিলে এই আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়নের দৌড়ে আছেন ৯ জন।

জাতীয় পার্টি থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন বর্তমান সাংসদ মোহাম্মদ নোমান, জাতীয় পার্টির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ মো. ফায়িজ উল্যাহ শিপন। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) থেকে আছেন আকতার হোসেন চৌধুরী।

দলীয় সূত্র জানায়, এক বছর ধরে দলে দ্বিধাবিভক্তি অনেকটা প্রকাশ্যে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক নেতা আরেক নেতার বিরুদ্ধে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। এখন কাজী শহিদ ইসলামকে ঠেকাতে ভেতরে-ভেতরে একজোট হারুনুর রশিদ ও এহ্সানুল কবির জগলুল।

এহ্সানুল কবির বলেন, শহিদ ইসলাম দলের কোনো পদে নেই। এমনকি সদস্যও নন। তিনি মোটরসাইকেল ও টাকা বিলি করে রাজনৈতিক পরিবেশ নষ্ট করছেন।

তবে শহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমি দলের জন্য কাজ করছি। আমার টাকায় লক্ষ্মীপুর-২ আসনে দল চলছে। অন্যরা তো দলের জন্য কোনো টাকা খরচ করছেন না। কর্মীদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন না। বিভক্তির অভিযোগ সঠিক নয়।’

বর্তমান সাংসদ মোহাম্মদ নোমান বলেন, ‘আমি জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত হলেও আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়েই উন্নয়নমূলক কাজ করেছি। আশা করছি, এবারও জোট থেকে মনোনয়ন পাব।’

বিএনপি জোটে তিনজন

২০০১ সালের নির্বাচনে এই আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন ২৯ জন। ১৯৯৬ সালে ছিলেন ২৪ জন। শেষ পর্যন্ত কোন্দল এড়াতে খালেদা জিয়া দুবারই এই আসন থেকে নির্বাচন করেন।

নেতা-কর্মীদের ভাষ্য, রায়পুর বিএনপির ‘দুর্গ’ হওয়ায় প্রার্থিতা পেলেই জয় মোটামুটি নিশ্চিত। তাই এ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর সংখ্যা বেশি। খালেদা জিয়া নির্বাচিত হওয়ার পর আসনটি ছেড়ে দিলে ২০০১ সালে উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন আবুল খায়ের ভূঁইয়া।

নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, ২০০১ ও ২০০৮ সালে দুবার নির্বাচিত হওয়ার পর এই আসনের রাজনীতি চলছে খায়ের ভূঁইয়ার ইশারায়। দলের অন্য কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার আগ্রহের কথা প্রকাশ করলে তাঁকে নানাভাবে হেনস্তা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

খায়ের ভূঁইয়া ছাড়া এবার মাঠে রয়েছেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা উপদেষ্টা লে. কর্নেল (অব.) আবদুল মজিদ। এ ছাড়া লক্ষ্মীপুর জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির রুহুল আমিন ভূঁইয়ার জন্যও আসনটি দাবি করা হচ্ছে।

আবদুল মজিদ বলেন, ‘এই আসনে বিএনপির রাজনীতিতে স্বৈরতন্ত্র চলছে। কেউ প্রার্থী হলে হামলা-মামলা দেওয়া হয়। তাই অনেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু খায়ের ভূঁইয়া এবার অঙ্কে ভুল করেছেন। আমি ছেড়ে দেওয়ার মানুষ না। আশা করি দল আমাকে মনোনয়ন দেবে।’

সার্বিক বিষয়ে আবুল খায়ের ভূঁইয়া বলেন, ‘দলের মধ্যে মান-অভিমান ছিল। সেগুলো মিটিয়ে ফেলেছি। দলের সব কর্মসূচি পালন করছি। এলাকার তৃণমূলের নেতা-কর্মীসহ অনেকেরই বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়াচ্ছি।’

কোনোভাবেই আসনটি বিএনপিকে ছেড়ে দেবেন না বলে জানিয়েছেন রুহুল আমিন ভূঁইয়া। তিনি বলেন, প্রয়োজনে স্বতন্ত্র থেকেও নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত আছে।