একটি ইস্যুতে একদিকে বিএনপি, বাকিরা অন্যদিকে

ঐক্য হলে কিসের ভিত্তিতে দলগুলো আন্দোলন করবে বা মাঠে থাকবে, তা নিয়ে এখনো এক হতে পারেনি বিএনপি ও ঐক্য প্রক্রিয়ায় থাকা দলগুলো। একটি ইস্যুতে আটকে আছে আলোচনা। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানো, নাকি সমগ্র রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন, সে ব্যাপারে বিএনপির সঙ্গে কয়েকটি দলের মতপার্থক্য আছে।

ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে থাকা দলগুলো বলছে, বিএনপি চাইছে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানোর বিষয়টি প্রধান হোক। অন্যদিকে যুক্তফ্রন্ট, গণফোরাম ও বাম কয়েকটি দল চাইছে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনকে গুরুত্ব দিতে। তবে বিএনপি বলছে, রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন চাওয়ার সঙ্গে তাদের মতবিরোধ নেই। কেননা বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সরাতে না পারলে গুণগত পরিবর্তন সম্ভব না।

অবশ্য সব দলই বলছে, সরকার হটানো মানে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ীদের ক্ষমতায় বসানো।

বেশ কয়েক মাস ধরেই তিন দলের সমন্বয়ে গড়া যুক্তফ্রন্ট, গণফোরাম ও বিএনপি মিলে একটি ঐক্যে আসার কথা হচ্ছে। যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরাম অনেকটা এগিয়েছে। খুব শিগগিরই তাদের কোনো ঘোষণা আসবে। তবে বিএনপি এখনো আলোচনা, শর্ত, প্রস্তাবের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।

বিএনপির একটি সূত্র জানায়, জটিল কয়েকটি বিষয় এখানে সামনে চলে এসেছে। জামায়াত ছাড়া না–ছাড়া ও আসন ভাগাভাগির ব্যাপার বাদেও দলগুলো কী উদ্দেশ্যে এক হবে, সে ব্যাপারে তারা এখনো এক হতে পারেনি। বিএনপি মাঠে নামতে চায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানোর উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরাম চাচ্ছে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন, সেখানে ক্ষমতায় কে থাকবে সেটা বিষয় না। এ ছাড়া বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ যুক্তফ্রন্টের অন্য নেতারাও বিভিন্ন সময়ে দেশে ভারসাম্যের রাজনীতির কথা বলে আসছেন। গণফোরামের কার্যকরী সভাপতি সুব্রত চৌধুরীও বলেছেন, দেশের শুভ পরিবর্তন চায় তাঁর দল। কোনো দলের বিরুদ্ধে তাঁদের অবস্থান নয়।

জানতে চাইলে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানো ও রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন একটার সঙ্গে আরেকটা জড়িত। জনগণের ভোটের অধিকার, সুশাসন, গণতান্ত্রিক অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা—এগুলো বর্তমানে অনুপস্থিত। এগুলো ফিরিয়ে আনতে হলে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে, যেখানে সবার একমত হওয়া জরুরি। এখানে পরিবর্তন ও সরকার পতন আলাদা বিষয় না। তিনি বলেন, এ বিষয়ে অন্যদের দ্বিমত হওয়ার কোনো কারণ থাকা উচিত বলে মনে করি না।’

এ ব্যাপারে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বলেছি তাদের (বিএনপি), আমরা এই আন্দোলন কোনোভাবেই করছি না একটি দলকে সরিয়ে আরেকটা দলকে বসানোর উদ্দেশ্য নিয়ে। আমরা পরিবর্তনের কথা বলছি, তার সঙ্গে একমত হতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, পুরো দেশের শাসন ব্যবস্থার একটা পরিবর্তন চান তাঁরা, যেখানে আইন, দুর্নীতি কমানো ও সুশাসনের জন্য কী কী করা যেতে পারে, এসব চায় যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরাম।

তবে যুক্তফ্রন্টের শরিক এই নেতা জানান, ‘একাদশ জাতীয় নির্বাচনকালীন সরকার শুধু আওয়ামী লীগের হবে, সেটা কেউ চায় না। এত বড় একটা স্বেচ্ছাচারী সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়াতে কারও দ্বিমত নেই।’ তবে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগকে সরিয়ে অন্য কাউকে আনা হবে আবার তারাও স্বৈরাচারী হয়ে যাবে, সেটাও হতে দেওয়া যাবে না। এখানে ক্ষমতার ভারসাম্যের বিষয়টি দেখতে হবে। মান্না আরও বলেন, এগুলো সবই আলোচনা হচ্ছে। কোথাও কিছু থেমে নেই।

বিএনপিসহ অন্য দলগুলো ঐক্য করতে আলোচনা শুরু করেছে। এরই মধ্যে বিএনপি থেকে ঐক্য প্রক্রিয়ায় আসতে চাওয়া দলগুলোর কাছে ১০টি দাবি জানানো হয়েছে, যার মধ্যে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনসহ অন্যান্য বিষয়ের উল্লেখ আছে। বিএনপির এক সূত্র জানায়, বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে যেসব দাবির ভিত্তিতে এ ঐক্য হতে পারে, সে ব্যাপারে কিছু দাবি বিএনপি থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে। সূত্রটি জানায়, বিএনপি বাদে গণফোরাম, বিকল্পধারা ও নাগরিক ঐক্যও আলাদাভাবে কিছু দাবি জানিয়েছে। এ ছাড়া কিছু বাম দলও নিজেদের মতামত জানিয়েছে।

বিএনপির এই ১০ দফা দাবি প্রসঙ্গে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ঐক্যের ভিত্তির ব্যাপারে বিএনপি প্রস্তাব দিয়েছে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি তা পাননি বলে জানান। তিনি বলেন, ওই প্রস্তাবে সাধারণ কথাবার্তা আছে যা মেনে নিতে অসুবিধা হওয়ার কথা না। কিন্তু এটা নিয়ে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। বিএনপির শর্তে শুরুতেই খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি প্রসঙ্গে বলেন, দলগতভাবে বিএনপির তা থাকতে পারে। কিন্তু যখন তারা জোটে আসবে তখন ১ নম্বর দাবি হিসেবে জাতীয় দাবি প্রাধান্য পাবে। সেখানে অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ১ নম্বরে আসবে।

খালেদার মুক্তির বিষয়ে বিএনপির নেতা খন্দকার মোশাররফ বলেন, বিভিন্ন দল থেকে নানান মতামতই আসছে। খালেদার মুক্তির বিষয়সহ এই দফার বিষয়ে একমত হওয়া নিয়ে এখনো কোনো আলোচনা শুরু হয়নি। তিনি জানান, ঐক্যটা কীভাবে হবে, তা নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো আলাপ হয়নি। তবে সেপ্টেম্বরেই এ ঐক্য হওয়া উচিত বলে মনে করেন।

২৫ আগস্ট বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একা পুরান ঢাকার সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। সাক্ষাতে খালেদা জিয়াও ২০-দলীয় জোটের ঐক্য ধরে রাখার পাশাপাশি একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ার যে প্রক্রিয়া চলছে, তা যথাসম্ভব দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করেছেন।