চার শিশুর এখন কী হবে?

বাবার মৃত্যুর খবর শুনে মা জয়নাব বেগমকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে আসে দুই শিশু তারিন আক্তার (বামে) ও জেরিন আক্তার। তাদের কান্না কেউ থামাতে পারছিল না। গতকাল দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে।  জুয়েল শীল
বাবার মৃত্যুর খবর শুনে মা জয়নাব বেগমকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে আসে দুই শিশু তারিন আক্তার (বামে) ও জেরিন আক্তার। তাদের কান্না কেউ থামাতে পারছিল না। গতকাল দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। জুয়েল শীল

মা জাহেদা বেগম অনেক দিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। দিন ও রাতের বেশির ভাগ সময়ই তাঁর কাটত বিছানায়। তবুও মা বেঁচে ছিলেন—এটাই ছিল দুই শিশুকন্যা নাসরিন সুলতানা ও জেরিন আক্তারের কাছে অনেক কিছু। সব সময় অসুস্থ মাকে জড়িয়ে ধরে থাকত তারা। সেই প্রিয় মা মুহূর্তেই জীবন থেকে সরে গিয়ে অতীত হয়ে গেলেন—ভাবতেই পারছে না দুজন। তাই শোকার্ত দুটি শিশু কোনো কথাই বলতে পারছিল না। শুধু দুজনের চোখ বেয়ে পড়ছিল জল।

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় জাহেদার বড় বোন গোলজার বেগমের কালামিয়াবাজার এলাকার বাসায় গিয়ে দেখা গেল এই চিত্র। সকাল ৮টায় একটি বাস আরেকটি বাসকে পাশ কাটিয়ে যেতে গিয়ে চাপা দেয় জাহেদাদের পরিবহনকারী সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে। এতে জাহেদা এবং অটোরিকশাচালক জামাল হোসেন মারা যান। গুরুতর আহত হয়েছেন জাহেদার স্বামী মোহাম্মদ নাসির, বড় বোন গোলজার বেগম এবং নিকট আত্মীয় আলেখা খাতুন। বাসটি চালাচ্ছিলেন চালকের সহকারী। একটি দুর্ঘটনা। আর তাতেই যেন শেষ দুই পরিবারের স্বপ্ন।

জাহেদার নিকট আত্মীয় জাশেদুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, পরিবারটি একেবারেই অসচ্ছল। জাহেদার স্বামী নাসির দরজির কাজ করেন। একই ঘটনায় তিনিও গুরুতর আহত। এ অবস্থায় মা হারা দুই শিশুকে কীভাবে বড় করবেন—এটাই তাঁদের বড় চিন্তা এখন।

নিহত অটোরিকশাচালক জামাল হোসেনেরও দুটি শিশুকন্যা রয়েছে। বাবাকে দিনভর কষ্ট করতে দেখে খুব কষ্ট হতো তাঁর দুই মেয়ে তারিন আক্তার এবং জেরিন আক্তারের। তাই প্রথম শ্রেণিতে পড়া দুই বোনের স্বপ্ন ছিল ভালো করে পড়াশোনা করবে। তারপর বাবার কষ্ট দূর করবে। জামাল হোসেনও স্বপ্ন দেখতেন আদরের দুই কন্যাকে নিয়ে। গতকাল দুই মেয়ের দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার ফল প্রকাশের কথা ছিল। তাই সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় জামাল হোসেন বলেছিলেন পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলে তাঁকে ফোন করে জানাতে। তবে তাঁর কাছে সেই ফোনটি আর যায়নি। এর আগেই  তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

বাবার মৃত্যুর খবর শুনে মা জয়নাব বেগমকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে আসে দুই মেয়ে। তারা প্রথম আলোকে বলে, ‘এখন বাবা নেই। আমরা কার কাছে আবদার করব। কে আমাদের পড়াশোনা করাবে?’ তার মা জয়নাব বলেন, স্বামী অটোরিকশা চালাতেন। আর তিনি মানুষের বাসায় বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতেন। কষ্ট হলেও স্বামী ও দুই কন্যাকে নিয়ে ছিল তাঁর সুখের সংসার। স্বামীর আচমকা মৃত্যু তাঁর পরিবারটিকে তছনছ করে দিল।

ঘাতক বাসটির চালকের সহকারী মোহাম্মদ ইয়াছিনকে ধরে গণধোলাই দেয় স্থানীয় জনতা। এরপর পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে বাকলিয়া থানায় নিয়ে যায়। এ ঘটনায় মামলা প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানিয়েছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রনব চৌধুরী।

রোগ নির্ণয় পরীক্ষা করতে যাচ্ছিলেন জাহেদা

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের সামনে কাঁদছিলেন জাহেদা বেগমের ভাগনি লিমা আক্তার। দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন তাঁর মা গোলজার বেগমও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার খালা দীর্ঘদিন ধরে কিডনিজনিত রোগসহ নানা রোগে ভুগছিলেন। এক সপ্তাহ আগে নিজের বাড়ি থেকে আমাদের কালামিয়া বাজারের লিজা গার্ডেন এলাকার বাসায় এসেছিলেন। বৃহস্পতিবার সকালে আমার খালু (জাহেদার স্বামী), মা এবং এক আত্মীয়কে সঙ্গে নিয়ে তিনি নগরের প্রবর্তক এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে যাচ্ছিলেন রোগ নির্ণয় পরীক্ষা করাতে। কিন্তু বাসা থেকে ২০০ গজ দূরে যেতেই তাঁদের পরিবহনকারী অটোরিকশাকে চাপা দেয় বাস।’