আ.লীগে কোন্দল, বিএনপিতে ভীতি

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী-১ আসনে বিএনপির প্রার্থীকে ১৭ হাজার ৩৩৬ ভোটে হারিয়ে সাংসদ হয়েছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী। পরের বার বিএনপি ভোট বর্জন করায় সংসদে যেতে তাঁকে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করতে হয়নি। তবে এবার তাঁর বিরুদ্ধে এককাট্টা দলের সাত নেতা। স্থানীয়ভাবে ‘সেভেন স্টারস’ নামে পরিচিত এই নেতাদের দাবি, এবার জিততে হলে তাঁদের যেকোনো একজনকে মনোনয়ন দিতে হবে।

তানোর ও গোদাগাড়ী উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন ও ৪টি পৌরসভা নিয়ে এ আসন গঠিত। এখানে বিএনপিতে অবশ্য আওয়ামী লীগের মতো গৃহবিবাদ নেই, আছে জামায়াত-ভীতি। স্থানীয় বিএনপি মনে করে, দলীয় ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক মন্ত্রী আমিনুল হকের বিকল্প নেই। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত আমির মুজিবুর রহমান একসময় এখানে সাংসদ ছিলেন। এবার তাঁকেই জোটের প্রার্থী হিসেবে পেতে তৎপর জামায়াত। তাঁর পক্ষে এলাকায় এবার ঈদ শুভেচ্ছার পোস্টার সাঁটানো হয়েছে।

ফারুক চৌধুরী ২০০১ সালের নির্বাচনে আমিনুল হকের কাছে হেরে যান। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আমিনুলের বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা হলে গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি আত্মগোপন করেন। ফলে ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে না পারায় বিএনপির প্রার্থী হয়েছিলেন তাঁর বড় ভাই সাবেক পুলিশপ্রধান এনামুল হক। তিনি ফারুক চৌধুরীর কাছে হেরে যান।

আওয়ামী লীগে অন্তর্দ্বন্দ্ব
আওয়ামী লীগের প্রথম দফার মেয়াদের শেষ পর্যায়ে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে শিল্প প্রতিমন্ত্রী হন ফারুক চৌধুরী। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ হওয়ার পর দলের নেতাদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়তে থাকে। এরই ফল সেভেন স্টারস। গত বছরের ১৮ নভেম্বর গোদাগাড়ীর কাঁকনহাটে সমাবেশ করেন এই সাত নেতা। সেখানে মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে সাত নেতার নাম ঘোষণা করা হয়। তাঁরা হলেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বদরুজ্জামান ও মকবুল হোসেন খান, আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য আতাউর রহমান খান, জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজি মতিউর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক মনিরুল ইসলাম, জেলা কৃষক লীগের সহসভাপতি আবদুল ওহাব ও তানোর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুণ্ডুমালা পৌর মেয়র গোলাম রাব্বানী।

তাঁরা প্রতিশ্রুতি দেন, এই সাতজনের ভেতর থেকে একজনকে মনোনয়ন দিলে জয়লাভ সম্ভব হবে, অন্যথায় নয়। এরপর থেকেই একাধিক জনসভা করে প্রচারণা চালাচ্ছেন সেভেন স্টারস হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এই নেতারা। এ নিয়ে দলের ভেতরে বিরোধ তীব্র হচ্ছে।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর মতিউর রহমানকে চাকরিচ্যুত করা হয়। গত দুটি নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন চেয়ে পাননি। এবারও মাঠে রয়েছেন। মতিউর রহমান বলেন, ফারুক চৌধুরী জনগণের আস্থা হারিয়েছেন। তিনি মানুষের সঙ্গে প্রচণ্ড দুর্ব্যবহার করেন। মাদকের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি সরকারি তালিকাতেই উঠেছে। এসব কারণে তিনি গণবিচ্ছিন্ন।

সাংসদ ফারুক চৌধুরী বলছেন, তাঁর দায়িত্ব হচ্ছে রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরা। তাঁর দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন। নেত্রী মনে করলে তাঁকে মনোনয়ন দেবেন, না মনে করলে দেবেন না। তিনি বলেন, রাজশাহীতে একমাত্র এই আসনটিই নির্বাচনের জন্য গোছানো। মাদক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিনি কখনো বেআইনি তদবির করেন না, এটা প্রশাসনের সবাই জানে।

গোলাম রাব্বানী আগে ফারুক চৌধুরীর সঙ্গেই ছিলেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর তাঁদের দূরত্ব তৈরি হয়। গোলাম রাব্বানী বলেন, নেত্রী এবং দলের সাধারণ সম্পাদক অনবরতই বলছেন, তৃণমূলের সমর্থন যাঁর পক্ষে, তাঁকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে। এটাই যদি হয়, তাহলে তাঁর নামটাই উঠে আসবে।

গোদাগাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বদিউজ্জামান বলেন, তাঁর শতভাগ বিশ্বাস ফারুক চৌধুরী এবারও দলের মনোনয়ন পাবেন। সেভেন স্টারে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে মতিউর রহমান ছাড়া আর কেউ মন থেকে মনোনয়ন চান না।

বিএনপিতে জামায়াত-ভীতি

আমিনুল হক ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনবার এখানে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। দুই দফায় মন্ত্রীও ছিলেন। তবে তিনি ছাড়াও চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত সচিব জহুরুল ইসলাম, জেলা বিএনপির সাবেক যুববিষয়ক সম্পাদক সাজেদুর রহমান খান ও যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ক্যালিফোর্নিয়া বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক শাহাদৎ হোসেন মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে আলোচনায় আছেন। এ আসন থেকে ১৯৮৬ সালে জয়ী জামায়াতের মুজিবুর রহমান ২০-দলীয় জোট থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছে দলটি।

তানোর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, বিএনপি ও সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আমিনুল হকের ইতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে। গোদাগাড়ী-তানোরে তাঁর বিকল্প কোনো নেতাও এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। দলে ছোটখাটো গ্রুপিং থাকলেও সবাই আমিনুলের অনুসারী।

তবে জামায়াত নেতা মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কিছুটা হলেও দুশ্চিন্তায় আমিনুলের কর্মী-সমর্থকেরা। কারণ, মুজিবুর রহমানের কেন্দ্রীয়ভাবে শক্ত প্রভাব রয়েছে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের নেতা ছিলেন। আশির দশক থেকে ঢাকায় অবস্থানের কারণে বিএনপির হাইকমান্ডের সঙ্গে তাঁর সখ্য রয়েছে। তিনি বর্তমানে কারাগারে আছেন।

জেলা জামায়াতের মুখপাত্র আবু মো. সেলিম বলেন, এ আসনটি তাঁদের ছিল। এবারও তাঁরা চাইবেন এবং আসনটি পাবেন বলে আশাবাদী। গোদাগাড়ী উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবদুস সালাম বলেন, জামায়াত জোটে আছে। তাদের ভারপ্রাপ্ত আমির এ আসন থেকে একবার সাংসদ হয়েছিলেন। তারাও চাইতে পারে। কিন্তু আসনটি জামায়াতকে দেওয়া হবে না। এখানে আমিনুল হকের বিকল্প নেই।