সাংসদ রতনবিরোধীরা এককাট্টা

মোয়াজ্জেম হোসেন, নজির হোসেন, সৈয়দ রফিকুল হক, রফিকুল ইসলাম চৌধুরী
মোয়াজ্জেম হোসেন, নজির হোসেন, সৈয়দ রফিকুল হক, রফিকুল ইসলাম চৌধুরী

তিনটি উপজেলা নিয়ে গঠিত সুনামগঞ্জ-১ আসন। জেলার পাঁচটি নির্বাচনী আসনের মধ্যে আয়তনে এটিই সবচেয়ে বড়। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এখানে বড় দুই দলের অন্তত ১৫ জন মনোনয়নপ্রত্যাশী মাঠে সরব। সম্ভাব্য প্রার্থীদের এই জটের মধ্যে আলোচনা বেশি আওয়ামী লীগ নিয়েই। দলের মধ্যে কোন্দল থাকলেও বর্তমান সাংসদকে ঠেকাতে এককাট্টা বাকি মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। এবার সাংসদ বাদে অন্য কেউ দলীয় মনোনয়ন পাক, এটাই তাঁদের চাওয়া।

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, জামালগঞ্জ ও ধরমপাশা উপজেলা মিলে গঠিত এই আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৩০ হাজার ৫৫ জন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হন মোয়াজ্জেম হোসেন ওরফে রতন। তিনি পেয়েছিলেন ১ লাখ ৫১ হাজার ৮৭৫ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির রফিকুল ইসলাম চৌধুরী পেয়েছিলেন ৯৩ হাজার ৩৯৫ ভোট। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এখানে আবার সাংসদ নির্বাচিত হন মোয়াজ্জেম হোসেন।

আওয়ামী লীগ
তিন উপজেলাতেই দ্বন্দ্বে বিভক্ত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। এই দ্বন্দ্ব সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেনকে কেন্দ্র করেই। অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের অভিযোগ, সাংসদ নিজের মতো করে প্রতিটি উপজেলায় একটি বলয় তৈরি করেছেন। দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ কম। এতে দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন এবারও মনোনয়ন চান। নির্বাচন সামনে রেখেই এলাকায় সরকারের নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখছেন তিনি। অন্যদিকে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী বাকিরা পৃথকভাবে মাঠে গণসংযোগ ও প্রচারণায় থাকলেও তাঁদের মধ্যে ভেতরে ভেতরে একটা যোগাযোগ আছে। তাঁদের দাবি, বর্তমান সাংসদকে দিয়ে এবার এখানে নির্বাচনে নৌকার জয় সম্ভব নয়।

এই আসনের আরেক আলোচিত নাম সৈয়দ রফিকুল হক ওরফে সুহেল। আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রবীণ এই রাজনীতিক এখানে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে ১৯৭৯ সালে প্রথম সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৮৭ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ১৯৯১ সালে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান। সেবার আওয়ামী লীগ আসনটি জোটের শরিকদের ছেড়ে দেয়। তবে ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সাংসদ নির্বাচিত হন রফিকুল। এরপর তিনি আর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। সার্বিক বিবেচনায় এবার তিনি মনোনয়ন পাওয়ার আশা করছেন। মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ-বিষয়ক সম্পাদক শামীমা শাহরিয়ার, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক রণজিৎ সরকার, সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী সহসভাপতি রেজাউল করিম ওরফে শামীম, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হায়দার চৌধুরী ওরফে লিটন, সাবেক যুগ্ম সচিব বিনয় ভূষণ তালুকদার, ধরমপাশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি রফিকুল হাসান চৌধুরী, জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম তালুকদার।

শামীমা শাহরিয়ার বলেন, ‘আমি ১৪ বছর ধরে মাঠে আছি। হাওরের গ্রামে গ্রামে যাচ্ছি। গত নির্বাচনেও দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলাম। এবার নতুন প্রার্থী দেওয়ার দাবি দলীয় নেতা-কর্মী সবার। সবাই পরিবর্তন চায়।’ রণজিৎ সরকার বলেছেন, ‘হাওরের কৃষকদের দুঃসময়ে দিনরাত পাশে ছিলাম। তাঁদের সঙ্গে কাজ করেছি। আশা করি দল মূল্যায়ন করবে।’

গত দশ বছরে এলাকায় যে উন্নয়ন হয়েছে তা অতীতে হয়নি দাবি করে সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেছেন, ‘এসব উন্নয়ন আমার হাত দিয়ে হয়েছে। এলাকার মানুষ আমাকে দুইবার নির্বাচিত করেছেন। নেত্রীর কাছে সব খবর আছে। মনোনয়ন দেওয়ার মালিক তিনি। আমি সবাইকে নিয়েই কাজ করি। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী।’

বিএনপি
জেলা বিএনপির নেতাদের দূরত্বের প্রভাব এই নির্বাচনী আসনের প্রতিটি উপজেলাতেই কমবেশি আছে। তবে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে সেটি আর প্রকাশ্যে নেই। এখন সবাই একসঙ্গেই বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। যদিও উপজেলা পর্যায়ে দলীয় কর্মসূচি এমনিতেই কম। তবে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের প্রচারণা ও গণসংযোগে মাঠে সরব নেতা-কর্মীরা।

বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে ঘুরেফিরে সাবেক সাংসদ নজির হোসেনের নাম বেশি আলোচিত হচ্ছে। তিনি ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন আট দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে এখানে প্রথম সাংসদ নির্বাচিত হন। তবে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ও ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে সাংসদ হন। ২০০৭ সালে এক-এগারোর সময়ে তিনি দলে ‘সংস্কারপন্থী’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও এখন ‘নেত্রীর নির্দেশে’ আবার মাঠে নেমেছেন, সক্রিয় হয়েছেন বিএনপির রাজনীতিতে।

২০০৮ সালের নির্বাচনে এখানে প্রার্থী ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য রফিকুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি এবারও মাঠে আছেন। এর বাইরে বিএনপির নতুন মুখ আছেন জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আনিসুল হক, তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান, জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও ধরমপাশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেব খান, যুক্তরাজ্য জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক হামিদুল হক আফিন্দি।

কামরুজ্জামান বলেন, ‘দলের পক্ষে, এলাকার মানুষের পক্ষে আমি দিনরাত মাঠে কাজ করছি। কেন্দ্রের নির্দেশেই মাঠে নেমেছি।’ দলের দুর্দিনে নেতা-কর্মীদের আগলে রেখেছেন, দলকে এখানে সংগঠিত করেছেন দাবি করে আনিসুল হক বলেছেন, ‘কেন্দ্রীয় নেতাদের আশ্বাসেই দীর্ঘদিন থেকে মাঠে আছি। আশা করি মনোনয়ন পাব।’ মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন বলে মনে করেন রফিকুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে আমি মাঠে আছি। হামলা-মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছি।’ আর নজির হোসেন বলেন, এই মুহূর্তে তাঁরা দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে ভাবছেন। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাঁকে মুক্ত করাই তাঁদের প্রধান কাজ। নির্বাচনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি নেত্রীর নির্দেশে মাঠে নেমেছি। তরুণ যাঁরা মনোনয়ন চাইছেন, তাঁরাও আমার হাতেই তৈরি। এখন আমার কাজ হলো সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে দলকে শক্তিশালী করা। না হলে এখানে আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করা যাবে না।’