রোল বলের রোল মডেল

রোল বল খেলায় দেশসেরা দিনাজপুর নারী দলের খেলোয়াড়েরা। গত বিশ্বকাপেও ছিলেন এই দলের পাঁচ খেলোয়াড়। সম্প্রতি দিনাজপুর বাস্কেটবল মাঠে।  ছবি: প্রথম আলো
রোল বল খেলায় দেশসেরা দিনাজপুর নারী দলের খেলোয়াড়েরা। গত বিশ্বকাপেও ছিলেন এই দলের পাঁচ খেলোয়াড়। সম্প্রতি দিনাজপুর বাস্কেটবল মাঠে। ছবি: প্রথম আলো

মাথায় স্কার্ফ, পরনে ট্র্যাক-স্যুট, কাঁধে ব্যাগ। এমন কয়েকজনের পিছু নিয়ে দেখা গেল, তাঁদের গন্তব্য দিনাজপুর শিশুপার্কের ভেতরের স্কেটিং মাঠ। শতাধিক ছেলেমেয়ে সেখানে রোলার স্কেটিং করছেন।

পরিত্যক্ত হেলিপ্যাডে নির্মিত স্কেটিং মাঠে কিছুক্ষণ স্কেটিং করে মেয়েদের একটি দল চলে গেল পাশের বাস্কেটবল মাঠে। সেখানে অস্থায়ী গোলপোস্ট বসিয়ে দুই দলে ভাগ হয়ে শুরু হলো রোল বল খেলা। খেলার ধরন হ্যান্ডবলের মতো; খেলতে হয় স্কেটিং পরে। এঁদের প্রশিক্ষক জাতীয় সাইক্লিং ফেডারেশনের সদস্য জাহাঙ্গীর আলম এবং দিনাজপুর সাইক্লিং পরিষদের প্রশিক্ষক শেখ রাসেল রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের সদস্য মো. নুরুল ইসলাম।

এই মেয়েরা দিনাজপুর রোল বল দলের সদস্য। মেয়েদের রোল বলে বর্তমান জাতীয় চ্যাম্পিয়নও দিনাজপুর। মাত্র এক বছরের প্রশিক্ষণে ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় রোল বলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন এই মেয়েরা। ২০১৭ সালে ফেডারেশন কাপেও তাঁরা চ্যাম্পিয়ন হন।

২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত রোল বল বিশ্বকাপে বাংলাদেশ নারী দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে তিনজন ছিলেন দিনাজপুরের। ২০১৭ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলে জায়গা করে নেন দিনাজপুরের পাঁচ মেয়ে। ওই পাঁচজন হলেন তমালিকা সুমনা, নওশিন তাবাচ্ছুম, ইশরাত জাহান, সাথিরা আখতার ও বর্ষা আখতার। সেবার বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল চতুর্থ স্থান অর্জন করে।

দিনাজপুরের মেয়েদের এই ভালো করার পেছনে যাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি জাতীয় সাইক্লিং প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত এবং বাংলাদেশ জাতীয় সাইক্লিং দলের প্রশিক্ষক ও বাংলাদেশ রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের সদস্য মো. সাহিদুর রহমান।

সাহিদুর রহমান জানান, সাইক্লিংয়ের পাশাপাশি রোলার স্কেটিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন তিনি। এরপর নিজের জেলা দিনাজপুরকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। খেলোয়াড় জোগাড় করতে হিতাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শে দিনাজপুরে একটি রোলার স্কেটিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। তখন দিনাজপুরে ছিল না কোনো স্কেটিং মাঠ। কিন্তু ফেডারেশনের সহকর্মী ও কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ২০০৫ সালে জাতীয় রোলার স্কেটিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় দিনাজপুরে। নির্মাণাধীন এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজের ভেতরের সড়কে অনুষ্ঠিত হয় ওই প্রতিযোগিতা।

ওই প্রতিযোগিতায় খুব একটা সাড়া মেলেনি। দমে যাননি সাহিদুর রহমান। কেটে যায় আরও ছয় বছর। ২০১১ সালে দিনাজপুর জিমনেসিয়ামে রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের আয়োজনে প্রথমবারের মতো ফ্রি ক্যাম্প হয়। আট দিনের সেই ক্যাম্পে দ্বিতীয় থেকে দশম শ্রেণির ৩৫০ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়। আশান্বিত হয়ে ওঠেন সাহিদুর। ক্যাম্প শেষে ফেডারেশন ২০ জোড়া স্কেটিং দেয় দিনাজপুরকে।

এরপর সাহিদুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম ও নুরুল ইসলাম দিনাজপুরে স্কেটিং খেলা চালু করার উদ্যোগ নেন। প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেন নুরুল ইসলাম। শহরের ইনস্টিটিউট মাঠে শুক্র ও শনিবার সকালে বিনা পারিশ্রমিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়। ২০১২ সালে জেলা প্রশাসন থেকে শিশুপার্কের পরিত্যক্ত হেলিপ্যাড ব্যবহারের অনুমতি পান তাঁরা।

২০১৩ সালে খবর আসে নতুন খেলা রোল বলের। কিন্তু মাঠ ও সামগ্রী নেই। ওই সময় সদর আসনের সাংসদ ইকবালুর রহিম ৫০ হাজার টাকা সহায়তা দেন। ওই বছরই স্কেটিং প্রশিক্ষণার্থীদের নিয়ে শুরু হয় রোল বলের প্রশিক্ষণ; নির্মাণাধীন বাস্কেটবল মাঠে। সেখানকার কর্তৃপক্ষ বাদ সাধলেÿখেলা চলে সদর হাসপাতাল চত্বরে।

২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো রোল বলের জাতীয় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। প্রশিক্ষকেরা আবেদন করলে বাস্কেটবল মাঠটি ব্যবহারের অনুমতি দেন জেলা প্রশাসক। পরে হেলিপ্যাডটি স্কেটিং মাঠ হিসেবে গড়ে তোলা হয়। সামান্য কয়েক দিনের প্রশিক্ষণে দিনাজপুরের মেয়েরা প্রথম জাতীয় রোল বল প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হন।

কিন্তু প্রয়োজনীয় মাঠ, সামগ্রী এবং নির্দিষ্ট প্রশিক্ষক না থাকায় খুঁড়িয়ে চলতে থাকে রোল বল খেলা। নুরুল ইসলাম জানান, মাঝেমধ্যে জাতীয়ভাবে শেখ রাসেল রোলার স্কেটিং ফেডারেশন থেকে প্রশিক্ষক পাঠানো হয়। তবে স্থায়ীভাবে বেতনভুক্ত কোনো প্রশিক্ষক নিযুক্ত করা হয়নি। রোল বলের জন্য ইনডোর মাঠ, উন্নত মানের স্কেটিং, লাইটিং সর্বোপরি একজন সার্বক্ষণিক প্রশিক্ষক প্রয়োজন। তিনি বলেন, ঢাকার খেলোয়াড়েরা যেখানে ১১০ মিলিমিটার চাকার স্কেটিং ব্যবহার করেন, সেখানে দিনাজপুরের খেলোয়াড়েরা মাত্র ৩৮ থেকে ৭৮ মিলিমিটার চাকার স্কেটিং ব্যবহার করেন।

প্রশিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সুযোগ-সুবিধা পেলে দিনাজপুরের মেয়েরা দ্রুতই বিশ্বে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করবেন।

বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দলে অংশগ্রহণকারী নওশিন তাবাচ্ছুম জানান, পড়াশোনার পাশাপাশি রোল বলই এখন তাঁদের স্বপ্ন। তাঁদের একটাই প্রতিজ্ঞা—রোল বলে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া।

তমালিকা সুমনা দিনাজপুর দলের অধিনায়ক। তিনি দিনাজপুর সরকারি কলেজের অর্থনীতি (সম্মান) বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। তাঁর বাড়ি বীরগঞ্জ উপজেলায়। সহখেলোয়াড় নওশিন তাবাচ্ছুমের বাবা প্রশিক্ষক নুরুল ইসলামের বাসায় থেকেই লেখাপড়া করছেন তিনি।  

তমালিকা জানান, বীরগঞ্জের মতো একটি স্থান থেকে উঠে আসতে যুদ্ধ করতে হয়েছে অনেক প্রতিকূলতার সঙ্গে। খেলাধুলায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন আর প্রশিক্ষক নুরুল ইসলামের সহযোগিতায় এ পর্যায়ে আসতে পেরেছেন তিনি।

যেদিন মেয়ের বিশ্বকাপে খেলার খবর পান সেদিন আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান তমালিকার বাবা ধানচাল ব্যবসায়ী তোফাজ্জল হোসেন। তিনি বলেন, ‘উপজেলা পর্যায় থেকে গিয়ে মেয়ে বিশ্বকাপে খেলবে, তা কোনো দিন ভাবিনি। মেয়ে এখন দেশসেরা দলের অধিনায়ক।’

দিনাজপুর কলেজিয়েট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্রী নওশিন তাবাচ্ছুম। সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী ইশরাত জাহান। মহিলা সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী সাথিরা আক্তার। মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী বর্ষা আক্তার। এঁরা এখন দেশের রোল বলের রোল মডেল। শত প্রতিকূলতার মাঝেও সব সাফল্যের জন্য অবৈতনিক প্রশিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলেননি তাঁরা। এই মেয়েদের জন্যই দিনাজপুর এখন রোল বলের সেকেন্ড হোম।