ছাড় দিয়ে হলেও বৃহত্তর ঐক্য চায় বিএনপি

>
  • বৃহত্তর ঐক্য গড়তে অনেক দিন ধরে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা
  • কয়েকটি বিষয়ে বিরোধীদের মধ্যে একধরনের বোঝাপড়া
  • ঐক্যের ক্ষেত্রে জামায়াতকে নিয়ে কয়েকটি দলের আপত্তি
  • ঐক্য গড়তে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার থাকবে বিএনপির
  • বিএনপি আলোচনা সাপেক্ষে আসন ছাড়তে প্রস্তুত

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের চেষ্টা তত জোরালো হচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ছাড় দিয়ে হলেও বৃহত্তর ঐক্য গড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা আশা করছে, চলতি মাসের মধ্যেই ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে ঐক্য একটি দৃশ্যমান রূপ নেবে।

বিএনপি, গণফোরাম ও যুক্তফ্রন্টের একাধিক সূত্র জানায়, একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অভিন্ন দাবি ও ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে গণতন্ত্রমনা দলগুলোর মধ্যে একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়তে অনেক দিন ধরে অনানুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা চলছে। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার, নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া, নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন ইত্যাদি বিষয়ে বিরোধী এসব দলের মধ্যে একধরনের বোঝাপড়া হয়েছে।

তবে গণফোরাম ও যুক্তফ্রন্ট চায় কেবল গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলেই হবে না। নির্বাচনের পর একটি কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে বর্তমান এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাষ্ট্রক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী ও কার্যকর করার জন্য একটা ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। এ জন্য সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার থাকতে হবে। এ জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, এ বিষয়ে এখনো কোনোরূপ রূপরেখা তৈরি হয়নি।

বিএনপির উচ্চপর্যায়ের সূত্র বলছে, ঐক্য গড়তে বিএনপির তরফ থেকে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আনা, সুশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিএনপি কী করবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার থাকবে। ঐক্য হলে গণফোরাম ও যুক্তফ্রন্টকে আলোচনা সাপেক্ষে নির্দিষ্টসংখ্যক আসন ছেড়ে দেওয়ারও চিন্তা বিএনপির আছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল শনিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘বৃহত্তর ঐক্য কখনোই হবে না, যদি আমরা সবাই কিছু না কিছু ত্যাগ স্বীকার না করি। ছাড় দিয়ে আমাদের একটা জায়গায় আসতে হবে।’

বিএনপি কী কী ছাড় দিতে পারে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আলোচনার মধ্য দিয়ে সবকিছু ঠিক হবে।’

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, তারা ঐক্যের লক্ষ্যে সম্ভাব্য দলগুলোর জন্য একটি প্রস্তাব বা ন্যূনতম শর্তের খসড়া তৈরি করেছে। দলটির নীতিনির্ধারকেরা আশা করছেন, গণতন্ত্র, নির্বাচন ও সুশাসনের স্বার্থে বিকল্পধারা, গণফোরাম, জেএসডি, নাগরিক ঐক্যসহ আরও কিছু দল ও জোটের সঙ্গে বিএনপির সমঝোতা হবে। এরপর তাঁরা একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি আদায়ে আলাদা অবস্থান থেকে যুগপৎ আন্দোলন গড়তে সক্ষম হবেন।

ঐক্য গড়ার ক্ষেত্রে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে কয়েকটি দলের আপত্তি আছে। বিএনপি মনে করে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেটা আর বড় কোনো সমস্যা নয়। কারণ, বৃহত্তর ঐক্য হলে হবে বিএনপির সঙ্গে। তাতে জামায়াত থাকবে না। জামায়াতে ইসলামী আগের মতোই বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটে।

বিএনপির নেতারা বলছেন, ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে যে ধরনের যুগপৎ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, এবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধেও তেমন একটা আন্দোলন গড়তে চাইছে বিএনপি। এই ঐক্য-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, ২২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন যে সমাবেশের ডাক দিয়েছেন, সেখান থেকে একটা বৃহত্তর ঐক্যের সূচনা হতে পারে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল প্রথম আলোকে বলেন, চলতি মাসের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য হতে পারে বলে তাঁরা আশা করছেন।

অবশ্য বিএনপির একটি সূত্র জানায়, ঐক্য নিয়ে তাঁদের কারও কারও মধ্যে কিছুটা সংশয় আছে। কারণ, তাঁরা যুক্তফ্রন্টের নেতাদের কারও কারও ভূমিকা বুঝে উঠতে পারছেন না।

যুক্তফ্রন্টের অন্যতম নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না প্রথম আলোকে বলেন, ঐক্য নিয়ে বিএনপির সঙ্গে তাঁদের আলোচনা হচ্ছে। তবে এখনো সুনির্দিষ্ট কিছু হয়নি। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন তাঁরা সবাই চান। এ জন্য নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার, সংসদ ভেঙে দেওয়া, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের মতো বিষয়গুলোতে তাঁরা একমত।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১২ সালে এ ধরনের একটি ঐক্য গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিল বিএনপি। সে সময় দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ওই প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে ছিলেন। কৃষক শ্রমিক জনতা পার্টি, গণফোরাম, বিকল্পধারা, জাসদ (রব), নাগরিক ঐক্যসহ কয়েকটি দলের সঙ্গে আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। এরপরও বিএনপির চেয়ারপারসন ও দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বিভিন্ন সময় জাতীয় ঐক্যের কথা বলেছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর ২০১৬ সালে গুলশানে জঙ্গি হামলার পর খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করে এই পরিস্থিতিতে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানান। এরপর খালেদা জিয়া কারান্তরীণ হওয়ার আগে গত ৩ ফেব্রুয়ারি আরেক দফা জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন। বিএনপি মনে করছে, ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপির একার পক্ষে সরকারকে চাপে ফেলা সম্ভব নয়। সরকারকে চাপে রাখতে ২০-দলীয় জোটের বাইরে একটি বৃহত্তর ঐক্যের প্রয়োজন।

এবার ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামের সঙ্গে এরই মধ্যে যুক্তফ্রন্টের একটা সমঝোতা হয়েছে। বিএনপির সঙ্গে সমঝোতার কোনো অগ্রগতি হয়েছে কি না, জানতে চাইলে গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করার ব্যাপারে কিছু কথাবার্তা তো আছেই। তবে আনুষ্ঠানিক আলোচনা এখনো শুরু হয়নি।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের মতে, সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ সব দল মিলে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে একটি জাতীয় সনদ করা উচিত। কিন্তু সেটা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে শক্তিশালী একটি বিরোধী দল বা জোট গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য ইতিবাচক।