রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফেরত পাঠাতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে হবে

রোহিঙ্গা সংকটের এক বছর পূর্তি হয়েছে। রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফেরত পাঠানোর জন্য মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে হবে। ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য মিয়ানমারের অভ্যন্তরেও ইতিবাচক জনমত তৈরি করতে হবে। সঠিক ইতিহাস তুলে ধরে রোহিঙ্গারা ‘বাঙালি’ বলে দেশটির সামরিক বাহিনী যে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে, তা পাল্টাতে হবে। এ ক্ষেত্রে কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি সুশীল সমাজকেও সক্রিয় হতে হবে।

রোহিঙ্গাদের শুধু মানবিক সহায়তা নয়, তাদের সম্মানের সঙ্গে মিয়ানমার যাতে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়, সে প্রক্রিয়াটিকে দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। কেননা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প সমাধান নেই।
আজ মঙ্গলবার প্রথম আলো আয়োজিত ‘রোহিঙ্গা সমস্যার এক বছর’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচক ব্যক্তিরা এসব কথা বলেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সিএ ভবনে প্রথম আলো মিলনায়তনে এ গোলটেবিল অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘ শিশু তহবিল—ইউনিসেফের সহায়তায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।

বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। তবে খারাপ সংকেত দিচ্ছে, ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া বিলম্বিত হতে পারে। দেশের ভেতরে নিরাপত্তা সংকটের পাশাপাশি এই অঞ্চলের বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাত তৈরির সম্ভাবনা বাড়ছে। এক বছর চলে গেছে, আমরা দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে পারব না। এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হলেও বাকি ১০ লাখের কী হবে? এই বিষয়টিকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে সামনে আনতে হবে।’
আলোচনায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট—ব্লাস্টের প্রধান আইন উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. নিজামুল হক বলেন, এত অল্প জায়গায় বিশাল জনগোষ্ঠীর বসবাসের ফলে শিবিরের ভেতরে অপরাধ, অন্যায়, অনিয়মের ঘটনা ঘটতেই পারে। রোহিঙ্গাদের নিজেদের মধ্যে যেসব সংঘাতের ঘটনা ঘটছে, সেসব ঘটনায় বিচারের ক্ষেত্রে নজরদারি বাড়াতে হবে।

ইউনিসেফের কমিউনিকেশন প্রধান জন জ্যাক সিমন শিশু সুরক্ষায় ইউনিসেফের পক্ষ থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, নিরাপদ খাবার পানির ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে বলেন, শিশু সুরক্ষায় কিছু অর্জন আছে। তবে সমাধান হলো এই শিশুদের মিয়ানমারে ফিরে যেতে সহায়তা করা। যত দিন তারা যেতে না পারছে, তত দিন এদের সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে।

প্রথম আলো আয়োজিত ‘রোহিঙ্গা সমস্যার এক বছর’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা। ছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলো আয়োজিত ‘রোহিঙ্গা সমস্যার এক বছর’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা। ছবি: প্রথম আলো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসীন বলেন, মিয়ানমারের ইতিহাসচর্চা বা ইতিহাস লেখার যে প্রকল্প, তাতে মিয়ানমারের দৃষ্টিকোণকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তাই বাংলাদেশেরও সময় এসেছে পাল্টা ইতিহাস লেখার। ১৯৭১ সালের পর কোনো বাঙালি সে দেশে গিয়েছে কি না, তা বিবেচ্য হতে পারে। ব্রিটিশ আমলের দায় বাংলাদেশ নেবে না। কেননা তখন বাংলাদেশ নামক কোনো রাষ্ট্র ছিল না। মিয়ানমারের প্রথম সংবিধানে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হলেও পরে বিভিন্ন ধাপে যে পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছে তা বিভিন্ন গবেষণা এবং লেখায় তুলে ধরতে হবে।

আমেনা মহসীন বলেন, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতে যে ধরনের ভূমিকা পালন করছে, এখন পর্যন্ত তা পর্যাপ্ত না। চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ওপর আন্তর্জাতিকভাবে চাপ তৈরি করতে হবে।

সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য মিয়ানমারের জনগণের পক্ষ থেকে যে ধরনের সমর্থন পাওয়ার কথা, তা খুব একটা অগ্রসর হয়নি। সেখানকার গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় নেতিবাচক প্রচারণার ফলে জনগণ সঠিক তথ্য জানতেই পারছে না। দেশের অভ্যন্তর থেকে জনসমর্থন তৈরি হলে তারাই সরকারকে এই জনগোষ্ঠীকে ফিরিয়ে নিতে চাপ দেবে। এ ধরনের সমর্থন আদায়ে দূতাবাসকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো যায়। কূটনৈতিকভাবে এবং সামাজিকভাবে এ জনসমর্থন আদায়ের সুপারিশ করেন তিনি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সত্যব্রত সাহা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিকভাবে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে যে স্বীকৃতি পাচ্ছে, তাতে করে ভবিষ্যতে মিয়ানমার এ দায় থেকে মুক্তি পাবে না। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়াসহ এ পর্যন্ত যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাকে সঠিক বলে উল্লেখ করেন তিনি।

অভিবাসী ও শরণার্থীবিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের কথা চিন্তার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই তাদের অন্য কোনো দেশে পুনর্বাসন করার বিষয়টিও চিন্তা করতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে শুধু মানসিক সহায়তা দিলেই হবে না, মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকেও ভাবতে হবে।

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ডিজাস্টার রেসপন্স অপারেশনের পরিচালক নাজমুল আজম খান বলেন, এর আগে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে দুই লাখকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে ১২ বছর সময় লেগেছে। তাই এবার আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে কত সময় লাগতে পারে, তা একটি বিবেচ্য বিষয়। ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া যত দীর্ঘ হবে, সমস্যা তত বাড়তে থাকবে। উখিয়ার জনগোষ্ঠীর সঙ্গে লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যোগ হয়েছে। তাই নিরাপত্তার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনায় নিতে হবে।

বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ট্রাস্টের সহকারী পরিচালক (রিসার্চ অ্যান্ড সোশ্যাল মিডিয়া) বরকত উল্লাহ মারুফ বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সহায়তায় সবার আগে এগিয়ে এসেছে ওই এলাকার স্থানীয় সাধারণ জনগণ। তবে এ অবদানের স্বীকৃতি সেভাবে মেলেনি। রোহিঙ্গাদের দেখভালে শুধু দাতা সংস্থার সহায়তার দিকে তাকিয়ে না থেকে স্থানীয় সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে, যাতে এরাই রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতে পারে। এ ছাড়া স্থানীয় জ্ঞানকেও কাজে লাগাতে হবে।

শিশুদের দিকে নজর বাড়াতে হবে: সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, শিশুদের সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমার থেকে আসা এতিম শিশুসহ বর্তমানে রোহিঙ্গা শিবিরে জন্ম নেওয়া ৬০ হাজার শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে হবে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক এবং রোহিঙ্গা শিশু সুরক্ষা কার্যক্রমের ফোকাল পয়েন্ট মো. সাজ্জাদুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া দীর্ঘ হলে শিশুদের শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয় নতুন করে চিন্তা করতে হবে। প্রয়োজনে দুবাইসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। চুক্তির আওতায় প্রশিক্ষণসহ বিভিন্নভাবে এই শিশুদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে তৈরি করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিচালক (প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোয়ালিটি) রিফাত বিন সাত্তার বলেন, নতুন আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রায় ৫৫ শতাংশই শিশু। গণমাধ্যমকর্মীসহ যাঁরা রোহিঙ্গা শিবিরে যাচ্ছেন তাঁদের এই শিশুদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হবে, তা নিয়ে কোনো প্রশিক্ষণ নেই। সবাই গিয়ে এই শিশুদের কাছে মিয়ানমারের ঘটনা জানতে চাচ্ছেন, এতে করে শিশুরা প্রতিনিয়ত সেই অভিজ্ঞতা মনে করতে বাধ্য হচ্ছে।

প্রথম আলোর উপদেষ্টা গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, শিবিরে এতিম শিশুদের আত্মীয় বা অন্য কোনো পরিবারের সঙ্গে রাখা হচ্ছে। পরিবারগুলো মেয়ে বাচ্চা নিতে বেশি আগ্রহী। কেন এ আগ্রহ, তা তলিয়ে দেখতে হবে।