নৌকা চান ৩ জন, বিএনপিতে তরিকুল একা

২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে কাজী নাবিল আহমেদের সঙ্গে শাহীন চাকলাদারের দ্বন্দ্ব চলে আসছে। আগামী সংসদ নির্বাচনে দুজনই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান। অনেক দিন ধরে নিষ্ক্রিয় থাকা খালেদুর রহমানও এখন সক্রিয়। তিনিও নতুন করে নৌকার ‘মাঝি’ হতে চাইছেন। যশোর-৩ (সদর) আসনে সরকারি দলের এ অবস্থায় অনেকটা সুবিধায় আছে বিএনপি।

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম এ আসনে একক প্রার্থী। অবশ্য শারীরিক অসুস্থতার কারণে তরিকুল নির্বাচন না-ও করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তাঁর ছেলে অনিন্দ্য ইসলাম প্রার্থী হতে পারেন।

২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখান থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন বিএনপির তরিকুল ইসলাম। তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী আলী রেজা রাজুকে (প্রয়াত) ৩৯ হাজার ৬৫১ ভোটে পরাজিত করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোটের প্রার্থী হন তরিকুল ইসলাম। তাঁকে ৪৩ হাজার ৬৪৩ ভোটে পরাজিত করেন মহাজোটের প্রার্থী খালেদুর রহমান। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ হন আওয়ামী লীগের কাজী নাবিল আহমেদ।

দ্বন্দ্ব-সংঘাতে আ.লীগ
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময় থেকে শাহীন চাকলাদারের সঙ্গে তীব্র বিরোধ চলছে সাংসদ কাজী নাবিল আহমেদের। এর আগে দ্বন্দ্বটা ছিল শাহীন চাকলাদারের সঙ্গে সাবেক সাংসদ খালেদুর রহমানের। তিনি সর্বশেষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। নৌকায় চড়েন কাজী নাবিল। এরপর খালেদুর রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। টানা চার বছর কোনো পক্ষের সঙ্গেই তাঁকে দেখা যায়নি। তবে গত দুই বছরে খালেদুর কিছুটা সক্রিয়। মাঝেমধ্যে তাঁকে রাজপথে দেখা গেছে। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে নিজের অনুসারীদের নিয়ে কয়েক বার শক্তির মহড়া দিয়েছেন।

খালেদুর রহমান আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান কি না, বিষয়টি শহরে এখন বেশ আলোচনার বিষয়। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এবার দলের কাছে মনোনয়ন চাইব। দল যদি নৌকা প্রতীক দেয়, তাহলে নির্বাচন করব।’

খালেদুরের সঙ্গে শাহীন চাকলাদারের বিরোধ প্রকাশ্যে আসে ২০১০ সালের মার্চে। তখন জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন নিয়ে দুই পক্ষের কোন্দল বাধে। সম্মেলনের দুদিন আগে খুন হন যশোর সদর উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক রিপন হোসেন ওরফে দাদা রিপন। তখন থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে দলীয় কোন্দলে যশোর সদরে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১২ জন নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। এর মধ্যে ৮ জন শাহীন চাকলাদারের অনুসারী। অপর ৫ জন খালেদুর রহমান ও কাজী নাবিলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। সর্বশেষ ১৩ মে খুন হন জেলা তরুণ লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মনিরুল শেখ। তিনি শাহীন চাকলাদারের অনুসারী ছিলেন।

সর্বশেষ ২০১৪–এর নির্বাচনে কাজী নাবিল নৌকার টিকিট পাওয়ায় শাহীন চাকলাদারের অনুসারীরা যশোর শহরে বিক্ষোভ করেন। এ অবস্থায় খালেদুর সমর্থন দেন কাজী নাবিলকে। এতে খালেদুরের পক্ষ কাজী নাবিলের সঙ্গে মিশে যায়। নতুন মেরুকরণ হয় রাজনৈতিক বিরোধের।

বর্তমানে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের জেলা শাখার নেতৃত্বে রয়েছেন শাহীন চাকলাদারের অনুসারীরা। আর আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের সদর উপজেলা ও শহর শাখার নেতৃত্বে নাবিল আহমেদের অনুসারী। দুই পক্ষ এখন আলাদাভাবে দলীয় কর্মসূচি পালন করছে। যে কমিটি যে নেতার অনুসারী, সেই কমিটির কর্মসূচিতে সেই নেতা প্রধান অতিথি বা প্রধান বক্তা হিসেবে যোগ দেন।

বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীন চাকলাদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যশোর-৩ আসনের ১৩৫টি ওয়ার্ডে নির্বাচনী সভা করেছি। এক বছর আগে থেকেই আমরা ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ কাজী নাবিলের ব্যাপারে তিনি বলেন, তাঁর কাছে দলীয় কর্মীদের পৌঁছাতে তিনটি ঘাট পার হতে হয়। এমনকি নেতা-কর্মীদের কারও ফোন তিনি ধরেন না।

তবে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য ও সাংসদ কাজী নাবিল আহমেদ বলেন, ‘শাহীন চাকলাদারের অভিযোগ ঠিক নয়। আমার দুয়ার সবার জন্যই খোলা। বরং শাহীনের কাছে মানুষ যেতে ভয় পায়। তিনি দুর্ধর্ষ প্রকৃতির লোক।’ তিনি বলেন, ‘সাড়ে চার বছর ধরে আমি যে উন্নয়নকাজ করছি, তার সবই নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ। আগামী নির্বাচনেও দলের কাছে মনোনয়ন চাইব। নৌকা প্রতীক পেলে ভোট করব।’

বিএনপি সুবিধাজনক অবস্থানে

তরিকুল ইসলাম খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক ও দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য। তিনি দলের প্রতাপশালী নেতা। একাধিকবার মন্ত্রী হয়েছেন। তবে অসুস্থতার কারণে এখন শয্যাশায়ী। তাঁর বক্তব্য জানার জন্য মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাঁর স্ত্রী নার্গিস বেগম বলেন, ‘তিনি খুব অসুস্থ।’

যোগাযোগ করা হলে তরিকুল ইসলামের ছেলে অনিন্দ্য ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রভাবমুক্ত নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে কি না, সেটা এখনো অনিশ্চিত। তারপরও দল যদি নির্বাচনে অংশ নেয় তাহলে আমার প্রথম চাওয়া হবে, বাবা সুস্থ হয়ে নির্বাচনে অংশ নিন। ব্যতিক্রম কিছু ঘটলে সময় বলবে আমি কী করব।’

তরিকুল ইসলাম বেঁচে থাকতে দল অন্য কাউকে যশোর-৩ আসনে মনোনয়ন দেবে, এমনটি ভাবছেন না দলীয় নেতা-কর্মীরা। এমনকি দলের কেউই তরিকুলের বিপরীতে প্রার্থী হতে চাইবেন না, এটা অনেকটা নিশ্চিত। তা ছাড়া বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে এ আসনে কেউই প্রচার-প্রচারণায় নেই। অবশ্য বিকল্প হিসেবে বিএনপির নেতা সৈয়দ সাবেরুল হকের নামও আলোচনায় আছে।

জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাবেরুল হক বলেন, ‘তরিকুল ইসলাম প্রার্থী হলে দলের অন্য কেউ প্রার্থী হবেন না। তবে তিনি যদি অসুস্থতার কারণে নির্বাচন করতে না চান, তাহলে আমি দলের প্রার্থী হতে চাই।’

অন্যান্য দল

যশোর-৩ আসনে জামায়াতে ইসলামী বা বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর ভোটের মাঠে তেমন প্রভাব নেই। তবে সব নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা ১৫-২০ হাজার ভোট পেয়েছেন। আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির জেলা সভাপতি সরু চৌধুরী নির্বাচন করবেন বলে আলোচনায় আছেন। আর জাসদ (ইনু) থেকে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যকরী সভাপতি ও যশোর জেলা কমিটির সভাপতি শেখ রবিউল আলম এবং জামায়াত থেকে দলটির জেলা নায়েবে আমির মো. ইদ্রিস আলী প্রার্থী হতে পারেন।