মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়াতে হবে

>

প্রথম আলো গতকাল ‘রোহিঙ্গা সমস্যার এক বছর’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে।

প্রথম আলো আয়োজিত ও ইউনিসেফের সহযোগিতায় গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। পাশে ব্লাস্টের প্রধান আইন উপদেষ্টা মো. নিজামুল হক। গতকাল কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে।  ছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলো আয়োজিত ও ইউনিসেফের সহযোগিতায় গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। পাশে ব্লাস্টের প্রধান আইন উপদেষ্টা মো. নিজামুল হক। গতকাল কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে। ছবি: প্রথম আলো

রোহিঙ্গা সংকটের এক বছর পূর্তি হয়েছে। রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফেরত পাঠানোর জন্য মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে হবে। ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াকে সহজ করার জন্য মিয়ানমারের অভ্যন্তরেও ইতিবাচক জনমত তৈরি করতে হবে। রোহিঙ্গারা ‘বাঙালি’ বলে দেশটির সামরিক বাহিনী যে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে, সঠিক ইতিহাস তুলে ধরে তা পাল্টাতে হবে। এ ক্ষেত্রে কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি সুশীল সমাজকেও সক্রিয় হতে হবে।

গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলো আয়োজিত ‘রোহিঙ্গা সমস্যার এক বছর’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আলোচকেরা এসব কথা বলেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সিএ ভবনে প্রথম আলো মিলনায়তনে জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) সহায়তায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।

বৈঠকের প্রধান অতিথি সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। তবে খারাপ সংকেত দিচ্ছে, ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া বিলম্বিত হতে পারে। দেশের ভেতরে নিরাপত্তার সংকটের পাশাপাশি এই অঞ্চলের বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাত তৈরির সম্ভাবনা বাড়ছে। এক বছর চলে গেছে, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য আমরা দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে পারব না। ১ লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হলেও বাকি ১০ লাখের কী হবে? এই বিষয়টিকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে সামনে আনতে হবে।’

আলোচনায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) প্রধান আইন উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. নিজামুল হক বলেন, এত অল্প জায়গায় বিশাল জনগোষ্ঠীর বসবাসের ফলে শিবিরের ভেতরে অপরাধ, অন্যায়, অনিয়মের ঘটনা ঘটতেই পারে। রোহিঙ্গাদের নিজেদের মধ্যে যেসব সংঘাতের ঘটনা ঘটছে, সেসব ঘটনায় বিচারের ক্ষেত্রে নজরদারি বাড়াতে হবে।

ইউনিসেফের কমিউনিকেশন প্রধান জন জ্যাক সিমন শিশু সুরক্ষায় ইউনিসেফের পক্ষ থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, নিরাপদ খাওয়ার পানির ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে বলেন, শিশু সুরক্ষায় কিছু অর্জন আছে। তবে সমাধান হলো এই শিশুদের মিয়ানমারে ফিরে যেতে সহায়তা করা। যত দিন তারা যেতে না পারছে, তত দিন এদের সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসীন বলেন, মিয়ানমারের দৃষ্টিকোণকে গুরুত্ব দিয়ে মিয়ানমারের ইতিহাস চর্চা বা ইতিহাস লেখার প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে। তাই বাংলাদেশেরও সময় এসেছে পাল্টা ইতিহাস লেখার। ১৯৭১ সালের পর কোনো বাঙালি সে দেশে গিয়েছে কি না, তা বিবেচ্য হতে পারে। ব্রিটিশ আমলের দায় বাংলাদেশ নেবে না।

আমেনা মহসীন বলেন, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত যে ধরনের ভূমিকা পালন করছে, এখন পর্যন্ত তা পর্যাপ্ত না। চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ওপর আন্তর্জাতিকভাবে চাপ তৈরি করতে হবে।

সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য মিয়ানমারের জনগণের পক্ষ থেকে যে ধরনের সমর্থন পাওয়ার কথা, তা খুব একটা অগ্রসর হয়নি। সেখানকার গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় নেতিবাচক প্রচারণার ফলে জনগণ সঠিক তথ্য জানতেই পারছে না। এ ধরনের সমর্থন আদায়ে দূতাবাসকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো যায়।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সত্যব্রত সাহা বলেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিকভাবে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে যে স্বীকৃতি পাচ্ছে, তাতে করে ভবিষ্যতে মিয়ানমার এ দায় থেকে মুক্তি পাবে না। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়াসহ এ পর্যন্ত যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা সঠিক বলে উল্লেখ করেন তিনি।

অভিবাসী ও শরণার্থী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, গত বছরে বিবিসির এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মালয়েশিয়ায় দেড় লাখ, ইন্দোনেশিয়ায় এক হাজার, থাইল্যান্ডে পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা বিভিন্ন সময় আশ্রয় পেয়েছে। আর বাংলাদেশে বর্তমানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের কথা চিন্তার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই রোহিঙ্গাদের অন্য কোনো দেশে পুনর্বাসন করার বিষয়টিও চিন্তা করতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে শুধু মানবিক সহায়তা দিলেই হবে না, মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকেও ভাবতে হবে।