নড়িয়া ভাঙবে, পূর্বাভাসও ছিল

পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বসতবাড়ি, হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থাপনা। গতকাল দুপুরে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মুলফতগঞ্জ এলাকায়।  ছবি: সাজিদ হোসেন
পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বসতবাড়ি, হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থাপনা। গতকাল দুপুরে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মুলফতগঞ্জ এলাকায়। ছবি: সাজিদ হোসেন
>
  • পূর্বাভাস থাকলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি
  • আরও ভাঙতে পারে
  • ভাঙন ঠেকাতে নতুন প্রকল্প

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) হিসাবে গত সাত বছরে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার প্রায় সোয়া ১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা নদীতে তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে ২০১১-১২ থেকে ২০১৪-১৫ সময়কাল পর্যন্ত নড়িয়াতে প্রতিবছর গড়ে আধা বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকা ভাঙনের শিকার হয়। এরপর থেকে ভাঙন বাড়তে থাকে। ২০১৫-১৬ সময়কালে বিলীন হয়েছে ১ দশমিক ৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা। এ বছর জুলাই থেকে ভেঙেছে প্রায় ২ বর্গকিলোমিটার।

অবশ্য সিইজিআইএস এ বছর পদ্মার নড়িয়াতে ভাঙনের পূর্বাভাস চার মাস আগেই দিয়েছিল। তারপরও সরকারের তরফ থেকে ওই সব জনপদ রক্ষায় কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই দুটি প্রকল্পের মাধ্যমে ভাঙন রোধে মোট ৪২ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। তাতে ভাঙন থামেনি।

নদী ও পানি বিশেষজ্ঞরা ভাঙনের জন্য নড়িয়ার ভূমির গঠন ও পদ্মা নদীর গতি-প্রকৃতিকে দায়ী করছেন। আর স্থানীয় কারও কারও ধারণা, ২০১৫ সালে পদ্মা সেতুর জন্য নদীশাসনের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে নড়িয়ায় ভাঙন বেড়েছে। তবে এমন ধারণার বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখার প্রয়োজন বলে মনে করেন নদী বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে পানিসম্পদমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অন্য কোনো কারণে নয়, পদ্মার এক পাড় ভাঙবে আর অন্য পাড় গড়বে, এটাই প্রকৃতির নিয়ম। ভাঙনের পূর্বাভাসের পরও কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ার বিষয়ে পানিসম্পদমন্ত্রী বলেন, ‘আগে বালুর বস্তা ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু ভাঙন রোধ করা যায়নি। এ শিক্ষা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা করে বড় প্রকল্পের মাধ্যমে ভাঙন রোধে উদ্যোগ নিয়েছি। বর্ষার পানি নেমে গেলে সেখানে কাজ শুরু হবে।’

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, নড়িয়ায় এত দিন কৃষিজমি ভেঙেছে। ফলে এ নিয়ে আলোচনাও কম হয়েছে। কিন্তু এ বছর প্রতিদিন নড়িয়ার কোনো না কোনো এলাকা ভেঙে পদ্মার বুকে বিলীন হচ্ছে। ওই এলাকার প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার এখন গৃহহীন। পরিবারগুলোর অন্তত ছয় হাজার স্থাপনা বিলীন হয়েছে। পাকা স্থাপনার মধ্যে একতলা থেকে চারতলা ভবনও ছিল। শুধু তা-ই নয়, নড়িয়ায় বিলীন হয়েছে বাঁশতলা, ওয়াপদা, সাধুর বাজার ও মুলফতগঞ্জ বাজারের ৩২০টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। সরকারি স্থাপনার মধ্যে রয়েছে একটি কমিউনিটি ক্লিনিকের ভবন, দুটি বিদ্যালয় ভবন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তিনতলা একটি ভবন, গাড়ির গ্যারেজ ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ক্যাম্পাসের একটি মসজিদ। তবে ভাঙন এখনো থামেনি।

এ বিষয়ে সিইজিআইএসের উপনির্বাহী পরিচালক ও ভাঙন পূর্বাভাস গবেষণার প্রধান সমন্বয়কারী মমিনুল হক সরকার প্রথম আলোকে বলেন, এই ভাঙন আগামী মাস পর্যন্ত চলতে পারে। সংস্থার পূর্বাভাস অনুযায়ী, আরও দেড় বর্গকিলোমিটার ভাঙনের কবলে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

নড়িয়ার মাটিতে বালুর পরিমাণ বেশি উল্লেখ করে মমিনুল হক সরকার বলেন, এক থেকে দেড় শ বছরের পুরোনো ওই ভূমির গঠনও শক্তিশালী নয়। ফলে পদ্মার স্রোতের তীব্রতায় সেখানে ভাঙন বেড়ে গেছে। সাধারণভাবে বালুর বস্তা ফেলে ভাঙন রোধের যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাতে কাজ না-ও হতে পারে। ফলে নড়িয়াকে বাঁচাতে হলে ওই এলাকার ভৌগোলিক গঠন ও ভাঙনের কারণগুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

নড়িয়ার সুরেশ্বর দরবার শরিফকে ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করতে ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৯০০ মিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। এ ছাড়া ২০১২-১৩ অর্থবছরে জলবায়ু ট্রাস্ট তহবিলের অর্থায়নে নড়িয়ার চন্ডপুর সাধুর বাজার ও পাঁচগাঁও এলাকায় ১২ কোটি টাকার বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। তারপরও কাজ হয়নি।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও নদী বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত মনে করেন, শরীয়তপুরের নড়িয়ায় এত দিন ধরে ভাঙন রোধে জোড়াতালির সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে। পদ্মার মতো একটি ভয়ংকর আগ্রাসী নদীর হাত থেকে নড়িয়াকে রক্ষা করতে হলে ভাঙনটি ঠিক কী কারণে হচ্ছে, নদীর কত গভীর পর্যন্ত মাটি সরে গেছে, এসব তথ্যসহ সামগ্রিক একটি সমীক্ষা করতে হবে। তারপর ভাঙন রোধে উদ্যোগ নিতে হবে। নয়তো আগের মতো নতুন প্রকল্পের টাকাও জলে যাবে।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সত্যজিৎ ঘোষ, শরীয়তপুর প্রতিনিধি)