গডফাদাররা আড়ালে, আসামি শুধু বাহক

>

• চট্টগ্রাম নগর-জেলার ৩২ থানায় মাসে গড়ে মাদকের মামলা ৫৬০টি
• তদন্ত শেষে মাসে গড়ে আদালতে অভিযোগপত্র জমা হয় ২১০টি
• মামলাগুলোর ৯৫ শতাংশই ইয়াবার
• ২০টি অভিযোগপত্রে দেখা গেছে, সবকটিতে শুধু বাহক আসামি
• নতুন বাহক দিয়ে চালু থাকছে মাদক ব্যবসা

চট্টগ্রামে হওয়া মাদক মামলাগুলোতে শুধু বাহককে আসামি করে অভিযোগপত্র দিচ্ছে পুলিশ। এতে আড়ালে থেকে যাচ্ছেন পাচারকারী চক্রের গডফাদাররা। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা নতুন বাহক দিয়ে চালু রাখছেন মাদক ব্যবসা। গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় মাদকের বিস্তার কমছে না বলে মনে করছেন সরকারি কৌঁসুলি।

আদালত সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম নগর ও জেলার ৩২ থানায় প্রতি মাসে গড়ে মাদকের মামলা হয় ৫৬০টি করে। তদন্ত শেষে প্রতি মাসে গড়ে আদালতে অভিযোগপত্র জমা হয় ২১০টি। মামলাগুলোর ৯৫ শতাংশই ইয়াবার।

গত ১৫ আগস্ট থেকে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আদালতে জমা হওয়া মাদক মামলার ২০টি অভিযোগপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, সবকটিতে শুধু বাহককে আসামি করা হয়েছে। এজাহারে যাঁদের নাম রয়েছে, অভিযোগপত্রেও তাঁদের আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তার আসামিরা ইয়াবা কিংবা মাদকগুলো কার কাছ থেকে নিয়েছেন, কার কাছে পৌঁছানোর কথা, কে বা কারা তাঁদের বাহক হিসেবে ব্যবহার করছেন, তার কোনো বর্ণনা নেই অভিযোগপত্রগুলোতে। প্রতিটি অভিযোগপত্র দুই থেকে তিন পৃষ্ঠার। এর বাইরেও একাধিক অভিযোগপত্র ঘেঁটে দেখেছেন এই প্রতিবেদক।

চট্টগ্রাম নগরের অলঙ্কার মোড়ে একটি মিনি ট্রাকে তল্লাশি চালিয়ে ৮৫ হাজার ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে ঢাকাগামী ট্রাকটির চেসিসে কৌশলে লুকানো ইয়াবা বড়িগুলো চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি উদ্ধার করা হয়। ওই সময় গ্রেপ্তার করা হয় চালক মো. এহসান ও তাঁর সহকারী মো. রহমত উল্লাহকে। এই ঘটনায় নগর ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) আকরাম হোসেন বাদী হয়ে গ্রেপ্তার দুজন ও গাড়ির মালিক নুরুল আমীনকে আসামি করে আকবর শাহ থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেন। গ্রেপ্তার দুজনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করে পুলিশ। তদন্ত শেষে গত ১৯ আগস্ট ওই তিনজনকে আসামি করে চট্টগ্রাম আদালতে এই মামলার অভিযোগপত্র জমা দেন নগর ডিবি পুলিশের এসআই মোমিনুল ইসলাম। দুই পৃষ্ঠার ওই অভিযোগে ট্রাকচালক ও সহকারী ইয়াবাগুলো টেকনাফে কার কাছ থেকে কিনেছিলেন, ঢাকায় কার কাছে পৌঁছানোর কথা, কিংবা কে তাঁদের ইয়াবাগুলো দিয়েছিলেন, এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর উঠে আসেনি তদন্তে। উদ্ধার হওয়া ইয়াবার মূল্য ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। একজন ট্রাকচালক ও সহকারীর পক্ষে এত টাকার ইয়াবা বড়ি কেনাবেচা সম্ভব কি না, তাঁদের পেছনে কারা, তা বেরিয়ে আসেনি। গ্রেপ্তার করা যায়নি গাড়ির মালিক নুরুল আমিনকেও। জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা মোমিনুল ইসলাম বলেন, অনেক চেষ্টা করেও গ্রেপ্তার আসামিদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া যায়নি।

চলতি বছরের ৯ এপ্রিল নগরের আকবর শাহ থানার সিটি গেট এলাকা থেকে ২০ হাজার ইয়াবা বড়িসহ রফিকুল ইসলাম নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তদন্ত শেষে ২০ মে শুধু তাঁকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে চারটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মাদক মামলায় তদন্তে বেশি সময় পান না তাঁরা। ১৫ দিনের মধে৵ অভিযোগপত্র দিয়ে দিতে হয়। উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে ৩০ দিন পর্যন্ত সময় পাওয়া যায়। এ কারণে তদন্তের গভীরে যাওয়া যায় না। আর গ্রেপ্তার আসামিরা সঠিক তথ্য দেন না। মাদক পাচারকারীদের পক্ষ নিয়ে তাঁদের আইনের আওতায় না আনার অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করেন তদন্ত কর্মকর্তারা।

পুলিশের তদন্তে মামলার গভীরে যাওয়া হচ্ছে না বলে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় বলে মনে করেন চট্টগ্রাম মহানগর সরকারি কৌঁসুলি মো. ফখরুদ্দিন চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বড় কোনো মামলায় তদন্তে ত্রুটি পেলে রাষ্ট্রপক্ষ নারাজি আবেদন করে অধিকতর তদন্তে পাঠায়। কিন্তু প্রতিদিন শত শত মাদক মামলার অভিযোগপত্র আসে আদালতে। সব দেখা সম্ভব হয় না।

তদন্তের সময় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে তদারকি করে মূল পাচারকারীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে হবে বলে মত দেন তিনি।

মাদক মামলার তদন্তে সময় কম পাওয়ার কথা বললেন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমানও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সময় কম থাকায় দ্রুত অভিযোগপত্র দিয়ে দিতে হয়। এরপরও গুরুত্ব দিয়ে তদন্তের জন্য কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে। কারও গাফিলতি পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি জানান, নগরের হালিশহরে ১৩ লাখ ইয়াবা বড়ি উদ্ধারের তদন্তাধীন একটি মামলায় টেকনাফ ও মিয়ানমারের কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে। এজাহারে তাঁদের নাম ছিল না।

চলতি বছরের শুরুতে চট্টগ্রাম নগর ও জেলায় মাদক ব্যবসায় যুক্ত ৯০ জনের একটি তালিকা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আরেকটি তালিকা করা হয় পৃষ্ঠপোষকদের। এই তালিকায় ৪৫ জন জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী এবং নগরের পাঁচ থানার ওসিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ২৫ সদস্যের নাম রয়েছে।