রোহিঙ্গা এতিম শিশুরা নাজুক অবস্থায়

নজিমুদ্দিনের বয়স ১২ বছর। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসার সময় শুধু দেশ নয়, সে ফেলে এসেছে মা, বাবা, ভাই, বোন সবাইকে। এক বছর ধরে রোহিঙ্গা শিবিরে থাকলেও সহায়তা পাওয়ার জন্য কোনো তালিকায় তার নাম ওঠেনি। শিবিরে ফুটফরমাশ করার পর বা দয়া করে কেউ খাবার দিলে খাবার জোটে। রাতে ঝড়-বৃষ্টি যা-ই হোক, তাকে ঘুমাতে হয় বিভিন্ন দোকানের সামনে।

১ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী ১২ রোহিঙ্গা শিবিরে কথা হয় নজিমুদ্দিনের সঙ্গে। তার গায়ে একটি স্যান্ডো গেঞ্জি। একটু বড়
বলে কাঁধের দিকটাতে গিঁট দেওয়া। লুঙ্গিটা ময়লা। গোসলের সময় অন্য কারও কাছ থেকে লুঙ্গি ধার নিয়ে গোসল করতে হয়। এক পায়ে রাবারের ছেঁড়া স্যান্ডেল। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলেও নাশতা খাওয়ার সুযোগ পায়নি সে।

আট ভাইবোনের মধ্যে নজিমুদ্দিন সবার বড়। বাবা ছাতা মেরামতের কাজ করতেন। মিয়ানমারে ঘটনার দিন নজিমুদ্দিন বাড়ি থেকে দূরে পুকুরে মাছ ধরতে গিয়েছিল। গোলাগুলি শুরু হলে নজিমুদ্দিন মাছ ফেলেই অন্যদের সঙ্গে হাঁটা শুরু করেছিল। সে জানে না তার মা, বাবা, ভাই ও বোন বেঁচে আছে, না মারা গেছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের শরণার্থীবিষয়ক সেলের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ২২ জুলাই পর্যন্ত রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে নজিমুদ্দিনের মতো পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, এতিম শিশুর সংখ্যা ৩৯ হাজার ৮৪১। এদের মধ্যে ৮ হাজার ৩৯১টি শিশুর মা-বাবা কেউ নেই।

জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফের সহায়তায় সমাজসেবা অধিদপ্তর রোহিঙ্গা শিশু সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় এতিম শিশুর তালিকা করাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে। ইউনিসেফ ও অধিদপ্তরের মধ্যে ১৭ কোটি ২২ লাখ ৫ হাজার টাকার চুক্তি অনুযায়ী কার্যক্রম শুরু হয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আগস্ট মাস পর্যন্ত মাত্র ১ হাজার ৬০৫টি ফস্টার কেয়ারগিভার (আত্মীয় বা অন্য যে পরিবারের সঙ্গে শিশুকে রাখা হচ্ছে) পরিবারকে এতিম শিশুর জন্য ২ হাজার টাকা হারে ৩২ লাখ ১০ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। চলতি মাসে মোট ৪ হাজার ৫৮৪টি শিশুর কেয়ারগিভারকে ৯১ লাখ ৬৪ হাজার টাকা বিতরণ করার কথা।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক এবং রোহিঙ্গা শিশু সুরক্ষা কার্যক্রমের ফোকাল পয়েন্ট মো. সাজ্জাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তালিকায় থাকা ৩৯ হাজার ৮৪১টি রোহিঙ্গা এতিম শিশুর মধ্যে ২০ হাজার ৮৫০টি শিশুর তথ্য যাচাই করা সম্পন্ন হয়েছে। এর বাইরে নতুন করে ২ হাজার ২১৫টি শিশুকে ঝুঁকির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই শিশুদের মধ্যে ২১ হাজার ৫৭২টি শিশুর ঝুঁকির মাত্রা চিহ্নিত করা হয়েছে। অতি ঝুঁকিতে থাকা শিশুর সংখ্যা ৫ হাজার ৯১৮।

সাজ্জাদুল ইসলাম বলেন, এই শিশুদের তথ্য যাচাইয়ের কাজটি সময়সাপেক্ষ। যেসব শিশুর নামে টাকা দেওয়া হচ্ছে, সেই টাকা কীভাবে খরচ করা হচ্ছে, তা-ও নজরদারি করা হচ্ছে। তাই কার্যক্রমের আওতায় এখন পর্যন্ত সব শিশুকে আনা সম্ভব হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার প্রথমে এই শিশুদের জন্য শিশুপল্লি করতে চাইলেও পরে এই শিশুরা যাতে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায় এবং মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার সময় আশ্রয় দেওয়া পরিবার যাতে এই শিশুদেরও সঙ্গে নিয়ে ফেরে, সে জন্য শিশুপল্লি করার পরিকল্পনা বাদ দিয়েছে।

নজিমুদ্দিন যে শিবিরে আছে, তার সাইট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব পালন করছে আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ। এ সংস্থার অফিসেই নজিমুদ্দিন কোনো তালিকা বা তার বিষয়ে কোনো কিছু হলো কি না, তার খোঁজ নিতে এসেছিল। সহায়তার কোনো তালিকায় যদি নাম না ওঠে, তখন কী হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে নজিমুদ্দিন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আর দাঁত দিয়ে দুই হাতের নখ কাটতে থাকে।

বালুখালী ১২ শিবিরে মাঝির সহায়তাকারী বা ডেপুটি মাঝি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা হামিদ জানালেন, তাঁরা মা-বাবা নেই, এমন ৪৪৯টি শিশুর তালিকা করে গত সাত মাস অপেক্ষা করছেন। এই শিশুরা বিভিন্ন সহায়তার অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছে।