হার্ডওয়্যার প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনের কেন্দ্র বাংলাদেশ

আপনার ব্যবহার করা ল্যাপটপ, স্মার্টফোন এখন ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ হতে পারে। বাংলাদেশ থেকেই এখন হার্ডওয়্যার যন্ত্রাংশ উৎপাদন করা হচ্ছে। হার্ডওয়্যার উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন আকর্ষণীয় ও সম্ভাবনাময় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এখানকার স্থানীয় বাজারের চাহিদা, প্রতিযোগিতামূলক দামে শ্রমিক পাওয়া ও ব্যবসাবান্ধব নীতির কারণে হার্ডওয়্যার উৎপাদনে বাংলাদেশ সম্ভাবনাময় খাতে পরিণত হয়েছে বলে সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে।

বাংলাদেশের হার্ডওয়্যার খাত নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা করেছে আন্তর্জাতিক বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ডেটা করপোরেশন (আইডিসি)। তাদের প্রতিবেদনে আইডিসি জানিয়েছে, স্থানীয় ও বৈশ্বিক হার্ডওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাফল্য দেখতে পেয়েছে তারা। ওয়ালটন ও স্যামসাংয়ের মতো প্রতিষ্ঠান এ দেশে হার্ডওয়্যার উৎপাদন করছে।

আইডিসির প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক মোবাইল ফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্যামসাং বাংলাদেশে স্মার্টফোন উৎপাদন শুরু করে। এখন স্থানীয় তিনটি প্রতিষ্ঠান, যেমন: ওয়ালটন, আমরা কোম্পানিজ ও সিম্ফনি দেশে উৎপাদন পর্যায়ে গেছে। এর বাইরে চীন-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে ট্রানশান হোল্ডিংস উৎপাদন শুরু করেছে।

দেশে হাইটেক শিল্প গড়তে সরকারি নানা সুবিধা দেওয়া হচ্ছে বলে আইডিসির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ বলছে, প্রযুক্তিশিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে কর কমানো, ক্যাশ ইনসেনটিভসহ নানা সুবিধা দিচ্ছে সরকার।

আইডিসির প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বাংলাদেশের তরুণেরা এখানকার বড় শক্তি। এখানকার আট কোটি মানুষের বয়স ২৫ বছরের কম।

আইডিসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে গ্যাজেটস ও ল্যাপটপের বাজার প্রায় ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার বা ১২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা (৮৪ টাকা ধরে)। ২০১৭ সালে দেশে ৩ কোটি ৪০ লাখ মোবাইল হ্যান্ডসেট বিক্রি হয়েছিল, যার মূল্য ১১৮ কোটি মার্কিন ডলার আর ল্যাপটপ বিক্রি হয়েছিল ৩০ কোটি মার্কিন ডলারের।

বোস্টন কনসালটিং গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জারিফ মুনীর বলেন, তরুণেরা এ খাতের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। প্রতিবছর দেশে গ্যাজেট ও ল্যাপটপের বাজার ১২ থেকে ২০ শতাংশ বাড়ছে।

আইডিসি তথ্য অনুযায়ী, ভারত ও চীনের তুলনায় বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যায় তরুণের সংখ্যা বেশি। দেশে মোট ৮০ মিলিয়ন তরুণ রয়েছে, যাদের সময় ২৫ বছরের নিচে। এ ছাড়া দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট ১২১টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সেখানে বিপুল পরিমাণ তরুণ পড়াশোনা করছেন। ফলে অন্য দেশের তুলনায় কম খরচে কর্মী পাওয়া যায়।

বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও দ্রুত এগিয়ে আসছে। ইতিমধ্যে দেশে ল্যাপটপ তৈরি করছে ওয়ালটন এবং তা নেপালে বিক্রি করছে, যা বাংলাদেশি কোম্পানির জন্য বড় অগ্রগতি।

ওয়ালটনের সূত্রে জানা গেছে, নেপালের বাইরে আফ্রিকার কয়েকটি দেশেও প্রযুক্তিপণ্য রপ্তানি করছে তারা।

চীনের অন্যতম প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা ও নেটওয়ার্ক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে বাংলাদেশে উন্নত অবকাঠামো ও নেটওয়ার্ক খাতে বিনিয়োগ করছে।

দেশে আগামী দুই বছরের মধ্যে প্রযুক্তিপণ্য তৈরির কারখানা তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে শাওমির।

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, ‘আমাদের স্থানীয় বাজারে যেমন ব্যাপক চাহিদা আছে, তেমনি প্রতিবেশী দেশগুলোতেও প্রযুক্তিপণ্য রপ্তানি করতে পারি। সরকার ২৮টি হাইটেক পার্ক স্থাপন করছে, যা আগামী দুই বছরের মধ্যে ব্যবহারের উপযোগী হয়ে যাবে। কিছুদিনের মধ্যেই এসব পার্কে উৎপাদন শুরু হবে।’

দেশে এখন স্মার্টফোন পেনিট্রেশন ৩০ শতাংশ, যা আগামী কয়েক বছরে ৮০ শতাংশে পৌঁছে যাবে।


বাংলাদেশ কেন আকর্ষণীয়
কম্পিউটার যন্ত্রপাতি নির্মাণের লক্ষ্য বাংলাদেশ এখন আকর্ষণীয় বাজার। আইডিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিনিয়োগকারীদের টেনে আনছে। দেশে জিডিপির আকার ২৪৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আর প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। দেশে ১২১ বিশ্ববিদ্যালয়, ৫১টি পলিটেকনিক, ২৮টি হাইটেক পার্ক ও ৭৯ অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে। এ ছাড়া আরেকটি বড় সুবিধা হচ্ছে, এ দেশের ২৫ বছরের কম বয়সী মানুষ আট কোটি। অর্থাৎ এখানে কর্মী বৃদ্ধির হার ভারত ও চীনের চেয়ে বেশি। কর্মীর গড় খরচ বাংলাদেশে মাসে ১২০ মার্কিন ডলার আর ভারতে ২০০ মার্কিন ডলার।

‘ড্রাইভিং এ ডিজিটাল বাংলাদেশ থ্রু হাইটেক ম্যানুফ্যাকচারিং’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রসঙ্গে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, আন্তর্জাতিক পরামর্শক ও গবেষণা সংস্থা আইডিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের নীতিগত সহায়তা, প্রতিযোগিতামূলক মজুরি কাঠামো এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে হার্ডওয়্যার পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ বিশ্বমানের হার্ডওয়্যার প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনের কেন্দ্র হতে চলেছে। একই কারণে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ বিনিয়োগকারীদের জন্যও অত্যন্ত আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠবে।

শ্রমের সহজলভ্যতা, প্রতিযোগিতামূলক বেতনকাঠামো, অভ্যন্তরীণ বাজারে হার্ডওয়্যার পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি এবং সহায়ক নীতিমালা থাকায় বাংলাদেশ হার্ডওয়্যার প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনের কেন্দ্র হয়ে উঠছে।

প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, যেমন: ওয়ালটন ও স্যামসাংয়ের সাফল্যের কথা তুলে ধরা হয়। এ সফলতার পেছনে রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের প্রণোদনামূলক নানা সহযোগিতা।

মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, হার্ডওয়্যার কাঁচামালের আমদানি শুল্ক হ্রাস করা হয়েছে। অফিস ভাড়ার ওপর ১০০ শতাংশ ট্যাক্স কমানো ও ক্যাশ ইনসেনটিভ সুবিধা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার, যা বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাপী হার্ডওয়্যার প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনের কেন্দ্র হতে সহায়তা করছে। দেশে ২৮টি হাইটেক পার্ক আগামী দুই বছরের মধ্যে তৈরি হয়ে যাবে। সরকার সেখানে বিদেশি বিনিয়োগ আহ্বান করছে। বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডে পরিণত করতে যেসব বাধা রয়েছে এবং যেসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা জরুরি, সেসব সম্পর্কে সরকার অবগত আছে।


দেশে ল্যাপটপের সম্ভাবনা
উদ্যোক্তারা আশা করছেন, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হার্ডওয়্যার রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হবে। বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সূত্র জানায়, বর্তমানে বছরে দেশে পাঁচ লাখ কম্পিউটার আমদানি করা হয়। এর সঙ্গে খুচরা যন্ত্রাংশসহ আরও তথ্যপ্রযুক্তি-বিষয়ক পণ্য আমদানি হয়। এ খাতে বছরে খরচ হয় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের হার্ডওয়্যার তৈরি করে কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব।

আইডিসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে ল্যাপটপের বাজার ৩০ কোটি মার্কিন ডলারের। ল্যাপটপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এ খাতে বিনিয়োগ শুরু করেছে। হার্ডওয়্যার অবকাঠামোর পাশাপাশি দক্ষ জনবল, সার্ভিস সেন্টার ও সেবা খাতে বিনিয়োগ করছে বিদেশি হার্ডওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো।

বিসিএসের তথ্য অনুযায়ী, হার্ডওয়্যার উৎপাদনকারী অনেক দেশ এখন আর হার্ডওয়্যার তৈরি করছে না। তারা এগুলো অন্য দেশ থেকে আমদানি করছে। ফলে যেসব দেশ এ খাতে দক্ষতা অর্জন করেছে, ওই সব দেশে ফরমাশ দিচ্ছে। বাংলাদেশও এখন এসব ফরমাশ পেতে শুরু করেছে। এ কারণে বাংলাদেশে হার্ডওয়্যার শিল্প দ্রুত বাড়ছে।

বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির তথ্য অনুযায়ী, দেশে স্থানীয় হার্ডওয়্যারের চাহিদা ব্যাপক আকারে বাড়ছে। দেশে যেসব হার্ডওয়্যার তৈরি হচ্ছে, তা দিয়ে দেশের চাহিদা মেটাতে পারলে অনেক অর্থ দেশে থাকবে। বর্তমানে দেশে পাঁচ লাখ হার্ডওয়্যারের চাহিদা আছে। তবে এর মধ্যে কিছু আমদানি হবে পূর্ণাঙ্গ কম্পিউটার হিসেবে বিদেশ থেকে। আর কিছু দেশীয় হার্ডওয়্যার ব্যবহৃত হবে। ২০২১ সালের মধ্যে দেশে চার থেকে পাঁচ লাখ পিস হার্ডওয়্যার তৈরি করা সম্ভব হবে। এর মধ্যে এক থেকে দুই লাখ পিস বিদেশে রপ্তানি করা যাবে। বাকিগুলো দেশে কাজে লাগানো হবে।

দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির (বিসিএস) সভাপতি সুব্রত সরকার বলেন, দেশে হার্ডওয়্যার খাতে সম্ভাবনা ব্যাপক। এ জন্য পরিকল্পনা করে এগোতে হবে। ছোট ছোট উদ্যোক্তার পাশে দাঁড়াতে হবে। ছোট উদ্যোক্তারা ইতিমধ্যে দেশে নানা যন্ত্রাংশ উৎপাদন করছেন। কম্পিউটারের নানা যন্ত্রাংশ এখন দেশে তৈরি হচ্ছে।

এ বছরের জানুয়ারিতে গাজীপুরের চন্দ্রায় দেশের প্রথম কম্পিউটার হার্ডওয়্যার উৎপাদন কারখানা উদ্বোধন করেছে ওয়ালটন। সরেজমিনে দেখা যায়, কারখানায় নিজস্ব মাদারবোর্ড, ল্যাপটপ ও স্মার্টফোন সংযোজন করছে ওয়ালটন। ওয়ালটনের কারখানায় দুই স্তরবিশিষ্ট মাদারবোর্ড তৈরি হচ্ছে। চলতি বছরের মধ্যেই ওয়ালটন মাল্টিলেয়ার মাদারবোর্ড তৈরিসহ কম্পিউটারের সবকিছুই, যেমন: র‍্যাম, এএসডি ডিভাইসেস ইত্যাদি নিজেরাই তৈরির পরিকল্পনা করছে। ওয়ালটন ডিজিটেক ইন্ডাস্ট্রিজ নামের ওই প্রতিষ্ঠানের অধীনে কম্পিউটার উৎপাদন ইউনিটটি স্থাপন করা হয়েছে। এখানে জাপান ও জার্মানির আধুনিক যন্ত্রপাতি দেখা যায়। সেখানে ল্যাপটপ ও কম্পিউটার নকশা তৈরি, গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগ, মাননিয়ন্ত্রণ বিভাগ ও টেস্টিং ল্যাব রয়েছে।

ওয়ালটন কর্তৃপক্ষ জানায়, কারখানায় মাসে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৬০ হাজার ইউনিট ল্যাপটপ, ৩০ হাজার ইউনিট ডেস্কটপ ও ৩০ হাজার ইউনিট মনিটর। কম্পিউটারের অন্যান্য এক্সেসরিজসহ পেনড্রাইভ, কি-বোর্ড ও মাউস উৎপাদন করছে ওয়ালটন। কারখানায় এক হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। বর্তমানে ওয়ালটনের তৈরি প্রযুক্তিপণ্য দেশের বাইরে নেপাল ও নাইজেরিয়ায় রপ্তানি হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে ওয়ালটনের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর এবং প্রতিষ্ঠানটির কম্পিউটার প্রজেক্ট ইনচার্জ ইঞ্জিনিয়ার মো. লিয়াকত আলী বলেন, দেশে বিভিন্ন প্রযুক্তিপণ্য, যেমন: মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এসব প্রযুক্তিপণ্যের আমদানিনির্ভরতা হ্রাসে ইতিমধ্যে ওয়ালটন দেশেই উৎপাদন শুরু করেছে। ওয়ালটন কারাখানায় তৈরি হচ্ছে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটারসহ অন্যান্য এক্সেসরিজ। এর ফলে দেশীয় হার্ডওয়্যার শিল্প গড়ে উঠছে এবং এ শিল্প বিকাশে ওয়ালটন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এতে কর্মসংস্থান বাড়ছে এবং ক্রেতারাও সাশ্রয়ী মূল্যে দেশে তৈরি প্রযুক্তিপণ্য পাচ্ছেন।

বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও মেশিনারিজ এবং উন্নত কাঁচামালের ব্যবহারে দেশের হার্ডওয়্যার শিল্প খাত আরও মজবুত করতে ওয়ালটনের এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান।

এর আগে দেশে দোয়েল নামে নিজস্ব ল্যাপটপ তৈরির চেষ্টা করে টেলিফোন শিল্প সংস্থা (টেশিস)। তবে দোয়েল ল্যাপটপ জনপ্রিয়তা পায়নি। সম্প্রতি দেশে নতুন ‘তালপাতা’ ল্যাপটপ তৈরিতে কাজ শুরু করেছে দেশি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডেটাসফট ম্যানুফ্যাকচারিং ও অ্যাসেম্বলি ইনকরপোরেটেড। লেখালেখির ইতিহাসে তালপাতার ব্যবহারের কথা স্মরণ করে ‘তালপাতা’ নামে ল্যাপটপ কম্পিউটার তৈরি করছে ডেটাসফট।

দেশি উদ্যোক্তারা ছাড়াও বাংলাদেশে ল্যাপটপ সংযোজন করবে হুয়াওয়ে। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এক সম্মেলনে জানান, বাংলাদেশে স্মার্টফোন ও অন্যান্য প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনে কারখানা স্থাপন করতে যাচ্ছে হুয়াওয়ে।

দেশের হার্ডওয়্যার খাতে বিনিয়োগ করছে ডেল। ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠান ও জনবলকে যুগোপযোগী করে তুলতে নতুন ডেটা সেন্টার সেবার ঘোষণা দিয়েছে ডেল। ডেলের পাশাপাশি আরও কয়েকটি বিদেশি হার্ডওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যতে বাংলাদেশে সংযোজন ও উৎপাদন কারখানা করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে।

স্মার্টফোনের বাজার
আইডিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে বর্তমানে মোবাইল ফোনের বাজার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বা ১১৮ কোটি মার্কিন ডলার। দেশে বছরে ৩ কোটি ৪০ লাখ ফোনসেট আমদানি করা হয়। দেশে বর্তমানে পাঁচটি কোম্পানি মোবাইল ফোনসেট সংযোজন কারখানা করেছে। এগুলো হচ্ছে ওয়ালটন, স্যামসাং, সিম্ফনি, আমরা ও ট্রানশান হোল্ডিংস। আগামী দুই বছরের মধ্যে শাওমি দেশে ফোন উৎপাদন করবে।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে বর্তমানে গ্রাহকের হাতে থাকা পৌনে তিন কোটি স্মার্টফোন পাঁচ কোটিতে উন্নীত হবে।

বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোবাইল সংযোজন করতে চাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে স্যামসাং, সিম্ফোনি, আমরা নেটওয়ার্কস, ট্রানশান ও আরও দুটি কোম্পানি।

সম্প্রতি শাওমি ইন্ডিয়ার ব্যবস্থাপক মানু কুমার জেইন বাংলাদেশ সফরে এসে প্রথম আলোকে জানান, বাংলাদেশের বাজার বুঝে ধীরে ধীরে স্থানীয় উৎপাদনে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

মানু বলেন, ‘বাংলাদেশের বাজার আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমরা বিশেষ নজরে রেখেই দেশের গ্রাহকদের জন্য সব ধরনের পণ্য, সেবা ও অন্যান্য সব সুবিধা নিয়ে আসছি। এরপর ধীরে ধীরে বাজার বুঝে স্মার্টফোন উৎপাদনসহ অন্যান্য প্রযুক্তিপণ্য উন্মুক্ত করা হবে।’

তাইওয়ানভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানও ভবিষ্যতে বাংলাদেশে স্মার্টফোন সংযোজন করার পরিকল্পনা করছে বলে প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা জানান।

দেশে স্মার্টফোন সংযোজন প্রসঙ্গে ও হার্ডওয়্যার খাত প্রসঙ্গে হুয়াওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, সরকারি একটি প্রকল্পের সঙ্গে তারা স্থানীয় সহযোগীদের সহযোগিতা। স্মার্টফোন সংযোজনের বিষয়ে পরিকল্পনা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে স্মার্টফোন ও ট্যাব মেলায় প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ‘এখানে যাতে ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইল ফোনগুলো তৈরি করতে পারি, তার জন্য ইকোসিস্টেম দাঁড় করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। সফটওয়্যার এক্সপোর্টে আমরা ভালো করছি, সার্ভিস সেক্টরেও গ্রোথ খুবই ভালো। এবার হার্ডওয়্যার সেক্টরে ইকোসিস্টেম দাঁড় করাতে আমরা মনোযোগী হয়েছি।’


আইওটি পণ্য
তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতিতে যুগ আসছে আইওটি বা ইন্টারনেট অব থিংসের। বাংলাদেশও এ খাতে যাত্রা শুরু করেছে। কম্পিউটার বা স্মার্টফোন নয় কিন্তু ইন্টারনেটে যুক্ত থাকে—সাধারণভাবে এমন যন্ত্র ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) পণ্য হিসেবে পরিচিত। এসব যন্ত্রকে আবার যেকোনো জায়গা থেকে নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করা যায়। প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের ফলে সারা বিশ্বেই বাড়ছে আইওটি পণ্যের ব্যবহার। বাংলাদেশেও এখন তৈরি হচ্ছে আইওটি পণ্য। শুধু তৈরিই নয়, দেশি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডেটাসফট এসব পণ্যের রপ্তানিও শুরু করেছে।

ডেটাসফটের ব্যবস্থাপক হাসান রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৯ সালে দেশে আইওটি পণ্যের বাজার চার হাজার কোটি টাকার বা অর্ধ বিলিয়নের বেশি, যা ২০২৫ সাল নাগাদ ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশের দক্ষ প্রকৌশলী ও পরিবেশ এ খাতে বাংলাদেশকে সম্ভাবনাময় করে তুলছে।

আইডিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডেটাসফট হাইটেক পার্কে তৈরি করছে আইওটি পণ্য। ডেটাসফটের লক্ষ্য শুধু দেশীয় বাজার নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাজারে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ লেখা আইওটি পণ্য পৌঁছে দেওয়া। গত ৩১ জুলাই বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো আইওটি পণ্য রপ্তানি করে প্রতিষ্ঠানটি। গাজীপুরের কালিয়াকৈরের বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় ও কারখানা। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক থেকে প্রথম রপ্তানি করা আইওটি পণ্য হলো পানির স্তর মাপার ইন্টারনেটভিত্তিক একটি যন্ত্র। সৌদি আরবের মক্কাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘স্যাক আল ভাতানিয়া’ এই যন্ত্র আমদানি করে বাংলাদেশ থেকে।

হার্ডওয়্যার খাতের উন্নতি
বাংলাদেশের হার্ডওয়্যার খাতে নানা উন্নতি হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান হার্ডওয়্যার উৎপাদন শুরু করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে কেবল প্রযুক্তিপণ্যের সরঞ্জামাদির আমদানির ডিউটি কমিয়েছে তা না, বাংলাদেশ সম্ভবত পৃথিবীর এমন একটা দেশ, যেখানে পণ্য উৎপাদন করে বিদেশে হার্ডওয়্যার রপ্তানি করলে ১০ শতাংশ ক্যাশ ইনসেনটেটিভ দেওয়া হচ্ছে। দেশি ও বিদেশি হার্ডওয়্যার নির্মাতারা তাই বাংলাদেশকে পরবর্তী গন্তব্য হিসেবে মনে করছে।

হার্ডওয়্যার শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, হার্ডওয়্যার খাতের এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে বাধা হচ্ছে উপযুক্ত পরিকল্পনা, ফান্ডিং ও সরকারের প্রতিশ্রুতি রক্ষা। দেশের সম্ভাবনাময় এ খাতকে সামনে এগিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এগিয়ে আসবেন বলে মত দিয়েছেন তাঁরা।