৫ দাবিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, ৯ লক্ষ্যে জোটবদ্ধ নির্বাচন

সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেন। ফাইল ছবি
সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেন। ফাইল ছবি

পাঁচ দফা দাবি আদায়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন এবং নয়টি লক্ষ্য বাস্তবায়নে জোটবদ্ধ নির্বাচন, সৎ, যোগ্য ব্যক্তিদের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে আইন প্রণয়ন-শাসনকাজ পরিচালনার অঙ্গীকার করে জাতীয় ঐক্য গড়ার ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন দুই প্রবীণ রাজনীতিবিদ সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেন।

আজ শনিবার বিকেলে এই দুই নেতা জাতীয় ঐক্যের ঘোষণা দিতে পারেন। ইতিমধ্যে এ জন্য ঘোষণাপত্রও তৈরি হয়েছে।

ঘোষণাপত্রে বিকল্পধারার সভাপতি বি. চৌধুরীকে তিনদলীয় জোট যুক্তফ্রন্টের সভাপতি ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামালকে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আহ্বায়ক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরামের এই জাতীয় ঐক্যে এখন দলের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৪-এ। তবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিরা ছাড়া এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল, সামাজিক শক্তি ও নাগরিক সমাজ এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় আসতে পারবে।

বি. চৌধুরী ও ড. কামাল বলছেন, তাঁরা জনগণকে সুসংগঠিত করে অভিন্ন দাবি আদায় এবং লক্ষ্য বাস্তবায়নে শান্তিপূর্ণ ও অহিংস গণ-আন্দোলন গড়ে তুলবেন এবং বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার কার্যকর উদ্যোগ অব্যাহত রাখবেন।

বিএনপি থেকে বেরিয়ে বিকল্পধারা গঠন করেন বি. চৌধুরী আর আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গণফোরাম গড়েন ড. কামাল। জাতীয় ঐক্য গড়ার ঘোষণাপত্রে এ দুই নেতা বর্তমান ক্ষমতাসীনদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তাঁরা সরকারকে জনসমর্থনহীন, অনির্বাচিত বলে উল্লেখ করেছেন।

তাঁরা বলছেন সন্ত্রাস, গ্রেপ্তার, মিথ্যা মামলা ও পুলিশ প্রশাসন ব্যবহার করে সরকার ক্ষমতায় টিকে আছে। জনসমর্থন নিয়ে কেউ যাতে ক্ষমতায় না আসতে পারে, সে জন্য তারা জনগণের অবাধ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অধিকারসহ গণতান্ত্রিক ও ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে। আগামী নির্বাচনে যেকোনোভাবে জয়লাভের জন্য ইভিএম পদ্ধতি প্রবর্তন, ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ একের পর এক কূটকৌশল অবলম্বন করছে। সন্ত্রাস, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নির্বিচারে জেল-জুলুম ও নির্যাতনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকারসহ, মৌলিক, মানবাধিকার ও সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্রসমাজের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন পুলিশ ও সরকারি নামধারী ছাত্রসংগঠন অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে দমনে লিপ্ত হয়েছে। এখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই, ভিন্নমতের কাউকে নির্বিঘ্নে সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া হয় না। রাষ্ট্রের আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগসহ সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রকে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বেচ্ছাচারী নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

এই দুই নেতা মনে করেন, এই পরিস্থিতি থেকে দেশ, জাতি ও জনগণকে মুক্ত করে রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বত্র কার্যকর গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার কোনো বিকল্প নেই।

জাতীয় ঐক্য পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলন করবে। এই দাবিগুলো হলো:

১. জাতীয় একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে হবে। ওই সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।

২. অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাক্‌, ব্যক্তি, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে।

৩. কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রছাত্রীসহ সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আনা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে এবং গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মুক্তি দিতে হবে। এখন থেকে নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা যাবে না।

৪. নির্বাচনের এক মাস আগে থেকে নির্বাচনের পর ১০ দিন পর্যন্ত মোট ৪০ দিন প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দিতে হবে।

৫. নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের চিন্তা ও পরিকল্পনা বাদ দিতে হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর যুগোপযোগী সংশোধন করতে হবে।

জাতীয় ঐক্য নয়টি লক্ষ্যের কথাও জানিয়েছে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলে তারা কী করবে, এই লক্ষ্যে তা বলা হয়েছে। তাদের লক্ষ্য হলো:

১. এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক নির্বাহী ক্ষমতা অবসানের জন্য সংসদে, সরকারে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা এবং প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ, ন্যায়পাল নিয়োগ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কার্যকর করা। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও সৎ যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগের জন্য সাংবিধানিক কমিশন গঠন করা।

২. দুর্নীতি দমন কমিশনকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার নিশ্চিত করা হবে। দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তুলে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি কঠোর হাতে দমন ও দুর্নীতির দায়ে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা।

৩. বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টি, বেকারত্বের অবসান ও শিক্ষিত যুবসমাজের সৃজনশীলতা ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাকে একমাত্র যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা।

৪. কৃষক-শ্রমিক ও দরিদ্র মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সরকারি অর্থায়নে সুনিশ্চিত করা।

৫. জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় সরকারসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতি ও দলীয়করণ থেকে মুক্ত করা।

৬. বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা আনা, সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার, সুষম বণ্টন ও জনকল্যাণমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা।

৭. জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য গঠন এবং প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ও নেতিবাচক রাজনীতির বিপরীতে ইতিবাচক সৃজনশীল এবং কার্যকর ভারসাম্যের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা।

৮. ‘সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’—এই নীতির আলোকে পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা।

৯. প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আধুনিক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও সমরসম্ভারে সুসজ্জিত, সুসংগঠিত ও যুগোপযোগী করা।

যুক্তফ্রন্টের নেতা ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরী কাছে ঐক্য প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি আজই ঘোষণা হবে। সেখানে দাবি আদায়ে কী ধরনের কর্মসূচি দেওয়া যায়, সে ব্যাপারে দুই নেতা বলবেন। একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে, মানুষের ভোটাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনতে জাতীয় ঐক্য হবে। এখানে কারা আসতে পারবেন আর কারা আসতে পারবেন না, তা ঘোষণা স্পষ্ট করা হবে।

যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরামের দায়িত্বশীল দুই নেতার সঙ্গে আলাপকালে তাঁরা বললেন, যেহেতু দুই দলের দুই শীর্ষ নেতা একটি ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন, তাই এ ব্যাপারে এই মুহূর্তে কিছু বলা ঠিক হবে না।