বিপ্লবের সূর্য ও বীরকন্যার দেশে

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ভাস্কর্য
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ভাস্কর্য

রাউজানের নোয়াপাড়া গ্রামটি চোখে লাগার মতো। সাপের মতো আঁকাবাঁকা সব সড়ক। জায়গায় জায়গায় বড় বড় দিঘি। শান্ত জনপদ। এখানেই জন্ম হয়েছিল বিপ্লবী সূর্য সেনের। লেখাপড়া শেষ করে শিক্ষকতার পেশায় ঢুকেছিলেন। সবার কাছে পরিচিত ছিলেন ‘মাস্টারদা’ নামে।

ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম সূর্য সেনের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধের সামনে। সূর্য সেন মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্রের ভেতরে কালো রঙের চার কোনা এই স্মৃতিসৌধ। পাশে বড় হচ্ছে একটি বকুলের চারা। এ বছরের ১৬ জানুয়ারি চারাটি রোপণ করে গেছেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। সূর্য সেনের বাস্তুভিটার অংশবিশেষে ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, স্টাফ কোয়ার্টার থাকলেও এটি তেমনভাবে চালু নেই।

দাঁড়িয়ে আছি স্মৃতিসৌধটির সামনে। মানসপটে ভেসে উঠছে একটি অবয়ব। বড় মাথা, ভরাট ললাট, ভাসা-ভাসা আগুন চোখের শক্ত-সামর্থ্য চেহারার যুবকটি। আজন্ম বিপ্লবী আত্মত্যাগের মহান আদর্শের এক উন্নত পুরুষ। যিনি চট্টগ্রাম কারাগারে হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছিলেন, ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি। বলা হয়ে থাকে, ফাঁসির পর সূর্য সেনের দেহ ব্রিটিশ সরকার গুম করে ফেলে। অনেকে বলে, জাহাজে করে নিয়ে বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর ফাঁসির পরও যুব বিদ্রোহ আরও কয়েক বছর ছিল। শেষে ১৯৪১ সালের ২৩ জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাই থানার দুর্গাপুরে বিপ্লবীদের সর্বশেষ ঘাঁটি থেকে গ্রেপ্তার হন বিপ্লবী দলের সর্বশেষ অধিনায়ক বিনোদ দত্ত। এর ভেতর দিয়ে শেষ হয় সূর্য সেনের নেতৃত্বে ১৯১৮ সালে শুরু হওয়া ব্রিটিশবিরোধী যুব বিদ্রোহের সব কর্মকাণ্ডের।

চট্টগ্রামে নিজ উপজেলা রাউজানে সূর্য সেনের নামে রয়েছে একটি চত্বর, একটি লাইব্রেরি ও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সন্ধ্যা হয়ে আসে। স্মৃতিসৌধে জ্বলে সন্ধ্যাপ্রদীপ। সন্ধ্যার আঁধারে মনে উঁকি দিয়ে যায় কত নাম। অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত সিংহ, লোকনাথ বল, গণেশ ঘোষ, সাবিত্রী দেবী, তারকেশ্বর দস্তিদার, মীর আহম্মদ—আরও কত বিপ্লবী। কিন্তু এর মধ্যেই ২২ বছরের এক তরুণীর চেহারা আচ্ছন্ন করে রাখে মন। সূর্য সেনের নাম এলে তাঁর নাম চলে আসে অবধারিতভাবে। বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।

পরদিন ১৮ জুলাই চট্টগ্রামের পটিয়া সদর থেকে আট কিলোমিটার দূরে প্রীতিলতার গ্রাম ধলঘাটে ছুটে যাই। আমরা এসেছি বীরকন্যা প্রীতিলতা সড়ক দিয়ে বীরকন্যা প্রীতিলতা সাংস্কৃতিক ভবনে। নিচতলায় কার্যালয়। সদ্য প্রতিষ্ঠিত এই ভবনের গায়ে প্রীতিলতার ছবি, আছে আবক্ষ মূর্তি।

বীরকন্যা প্রীতিলতা ট্রাস্টের সম্পাদক পংকজ চক্রবর্তী ট্রাস্ট ভবন করতে গিয়ে তাঁর সংগ্রামের কথা বলছিলেন। আর আমার চোখে ভাসছিল এই তরুণীর জীবন তিতিক্ষার চিত্র। বাবা ছিলেন তৎকালীন চট্টগ্রাম পৌরসভা অফিসের হেড কেরানি মধুসূদন ওয়াদ্দেদার। মা প্রতিভা ওয়াদ্দেদার। মা-বাবা আদর করে নাম রেখেছিলেন রানী। প্রীতিলতা লেখাপড়ায় ছিলেন ভালো। যা পড়তেন, মনে থাকত। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিপ্লবী চেতনা মনে ভর করে। এ ক্ষেত্রে তাঁকে প্রভাবিত করেন খুড়তুতো দাদা অমৃতসূদন ওয়াদ্দেদার। যিনি ছিলেন সূর্য সেনের ছাত্র। বিপ্লবের দামামা তখন বেজে চলেছে চারদিকে। এ সময় অমৃতর মাধ্যমে বেশ কিছু বিপ্লবী বই পড়ার সুযোগ হয় কিশোরী প্রীতিলতার। এর মধ্যে একটি বই ছিল বাঘা যতীন। পড়েন নাটোরের রানি ভবানী ও ঝাঁসির রানি লক্ষ্মী বাইয়ের জীবনী। এর মধ্যে ডা. খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন সাফল্যের সঙ্গে। ঢাকায় গিয়ে ইডেন কলেজে ভর্তি হলেন উচ্চমাধ্যমিকে।

পংকজ চক্রবর্তী ভবনটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন। এই কক্ষে হবে নাচের ক্লাস, এখানে মঞ্চ, এখানে গ্রামের নারীদের সেলাইসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। চোখের সামনে তখন যেন প্রীতিলতা এসে পড়েছেন। দেখছি এমন এক তরুণীকে, যিনি ইতিমধ্যেই বিপ্লবের বীজমন্ত্রে দীক্ষিত। মাস্টারদার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার উদগ্র বাসনা যাঁকে পেয়ে বসেছে। একসময় নেতার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হলো। নেতা বললেন, ‘ব্রিটিশরাজকে বুঝিয়ে দিতে হবে আমাদের নারীরাও কম নয়। তুমিই পারবে।’

একদিন প্রীতিলতার ওপর নির্দেশ এল চট্টগ্রাম শহরে পাহাড়তলীতে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে নেতৃত্ব দেওয়ার। সঙ্গে থাকবেন পাঁচ পুরুষ সদস্য। নিজেও পরেছেন পুরুষের পোশাক। আগের দিন দেখা করে এসেছেন মায়ের সঙ্গে। মাকে চিঠি লিখেছেন, ‘মা, ক্ষমা করো। তোমার কথা রাখতে পারলাম না। দেশ আজ পরাধীন। স্বাধীনতার সূর্য না উঠলে সবকিছু অর্থহীন। রানি ভবানী, ঝাঁসির রানি লক্ষ্মী বাই যদি পেরে থাকেন, আমি বীর চট্টলার রানি কেন পারব না?’

১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে ইউরোপিয়ান ক্লাব। রাত ১০টা। ক্লাবের বাবুর্চি করিম টর্চের আলো ফেলে সংকেত দিলেন। পশ্চিম দিকে কিছুটা ঝোপের দিক থেকে অমনি প্রীতিলতার নেতৃত্বে গুলি-বোমা নিয়ে মুহুর্মুহু আক্রমণ। বলরুমের নাচ থমকে গিয়ে কেবল মরণ-চিৎকার। অভিযান সফল। আক্রমণে নেতা সবার আগে, আর প্রত্যাবর্তনে নেতা সবার পেছনে, এই হলো যুদ্ধের নিয়ম। সেতু পার হয়ে পাহাড়তলী বাজার থেকে পৌঁছে যাবেন ঘাঁটিতে, এমন চিন্তা। হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে প্রীতিলতার বুকের বাঁ পাশে। এক হাত ক্ষতস্থানে চেপে ধরে এগোনোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পড়ে যান। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হয়। ওদিকে সুতীক্ষ্ণ বেয়নেট উঁচিয়ে এগিয়ে আসছে ইংরেজ সেনা। তখনই পকেটে থাকা পটাশিয়াম সায়ানাইড মুখে নেন প্রীতি। আহ শান্তি। মাটির কোলে ঘুমিয়ে পড়েন অগ্নিকন্যা।

প্রীতিলতার মৃত্যুতে মাস্টারদা কয়েকটি লাইন লিখেছিলেন। এতে তিনি বেথুন কলেজের দর্শনে স্নাতক বিপ্লবীকন্যা প্রীতিকে উল্লেখ করেন ‘স্নিগ্ধ সুষমায় ভরা একটি পবিত্র ফুল’ হিসেবে।

পংকজ চক্রবর্তী অনেক কথা বলে চলেন। এই গ্রামেরই মানুষ তিনি। একসময় এনজিওতে চাকরি করতেন। বহু সংগ্রামের পর অবশেষে এই সাংস্কৃতিক ভবন। এ কাজে পাশে পেয়েছেন বহু মানুষকে। বছর ষাটেকের পংকজ বললেন, ‘সারা দেশের মানুষ দূরে থাক, এই পটিয়ার অনেক মানুষই প্রীতিলতার কথা জানত না। আমরা স্কুলে স্কুলে প্রচারপত্র আকারে প্রীতিলতার জীবনী বিতরণ করেছি।’ তাঁর মতে, বিপ্লবীদের জীবন নিয়ে তেমন কোনো কাজ হয়নি।

পংকজ চক্রবর্তীর শেষ কথা, ‘প্রীতিলতার নামে একটি সাংস্কৃতিক ভবন হয়েছে। আমরা একটা ইতিহাস নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি, যে ইতিহাস সাধারণ মানুষের জানাশোনার বাইরে ছিল। কিন্তু আমরা মনে করি, মাস্টারদা নিয়েও এ রকম কিছু হওয়া উচিত। এটা আমাদের দাবি।’