জালিয়াতির ঘটনায় দুদকের আরেক মামলা, গ্রেপ্তার ১

টাঙ্গাইলে ফারমার্স ব্যাংকের শাখা খোলার দিনই একটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। সেদিনই অনলাইনে ওই হিসাবে জমা হয় ৪ কোটি টাকা। পরদিনই ওই হিসাবটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার আগে ওই ৪ কোটি টাকা ব্যাংকটির একই শাখায় নতুন আরেকটি হিসাব খুলে স্থানান্তর করা হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে ওই হিসাবে আরও কয়েক কোটি টাকা জমা হয়। দুদক অনুসন্ধান করে জেনেছে, জালিয়াতির উদ্দেশ্যে এসব কাজ করা হয়েছে।

এই জালিয়াতির ঘটনায় আরেকটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলায় ব্যাংকটির অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীর (বাবুল চিশতী) ছেলেসহ চারজনকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে একজনকে।

টাঙ্গাইল মডেল থানায় আজ রোববার সকালে মামলাটি করেন দুদকের উপসহকারী পরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন। মামলায় আসামি করা হয়েছে মাহবুবুল হক চিশতীর ছেলে রাশেদুল হক চিশতী, এসটুআরএস করপোরেশনের মালিক ফেরদৌস জুবায়েত ইসলাম ভূইয়া, ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখার এক্সিকিউটিভ অফিসার ও ব্যাংকটির জামালপুরের বকশীগঞ্জ শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক সাজলী শবনব এবং ব্যাংকের বগুড়া শাখার অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার ও টাঙ্গাইল শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক সোহেল রানাকে।

মামলার পরপরই দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ফেরদৌস জুবায়েত ইসলাম ভূইয়াকে। দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। 

মামলার এজাহারে বলা হয়, রাশেদুল হক চিশতীর মালিকানাধীন একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান আরসিএল প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজকে দুর্নীতির কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের নামে গত বছরের ২৪ জুলাই ফারমার্স ব্যাংকের টাঙ্গাইল শাখায় একটি চলতি হিসাব খোলা হয়। হিসাব খোলার দিনই ব্যাংকটির বকশীগঞ্জ শাখা থেকে অনলাইনে ১২টি নগদ জমার মাধ্যমে মোট ৪ কোটি টাকা জমা হয়। জমার ক্ষেত্রে জমাকারীরা অর্থের উৎসসংক্রান্ত কোনো ঘোষণা দেননি। ব্যাংকের ব্যবস্থাপকও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মোতাবেক সন্দেহজনক লেনদেন সম্পর্কে কোনো তথ্য জানাননি।
রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দুদক দেখেছে, ওই দিনই টাঙ্গাইলে ফারমার্স ব্যাংকের শাখাটি উদ্বোধন হয়। পরদিন ব্যাংকটির ওই শাখায় নতুন আরেকটি হিসাব খুলে ৪ কোটি টাকা ওই হিসাবে স্থানান্তর করা হয় এবং আগের হিসাবটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে ওই হিসাবে ব্যাংকটির মিরপুর শাখা থেকে ৫৪ লাখ টাকা অনলাইনে জমা হয়। নভেম্বরে ২টি স্লিপের মাধ্যমে ২ কোটি ৬৪ লাখ ৯০ হাজার এবং পরদিন ৫টি স্লিপের মাধ্যমে ২ কোটি ১০ লাখ ২ হাজার ৫০০ টাকা জমা হয়।
এসব নগদ লেনদেন সম্পর্কে ব্যাংক ব্যবস্থাপক কোনো তথ্য জানাননি। পরে নভেম্বরে আরসিএল প্লাস্টিকের নামে আরেকটি হিসাব খুলে সব অর্থ সেখানে স্থানান্তর করা হয় এবং আগের হিসাবটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। নতুন হিসাবটি থেকে ৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যাংকের গুলশান করপোরেট শাখার গ্রাহক এসটুআরএস করপোরেশনের ঋণ হিসেবে স্থানান্তর করা হয় ডিসেম্বরে। ওই হিসাব থেকে রাশেদুল হক চিশতীর নামে ব্যাংকের শেয়ার কেনা বাবদ অর্থ পে-অর্ডারের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়।

দুদক বলছে, আরসিএল প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া বাস্তব কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তারপরও প্রতিষ্ঠানের হিসাবটিতে কোটি কোটি টাকা নগদে জমা হওয়া, পরের দিন তুলে নেওয়া, প্রথম হিসাবটি বন্ধ করে দেওয়া, আবার একই প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকের একই শাখায় নতুন হিসাব খোলা সন্দেহজনক ও অস্বাভাবিক লেনদেনের পরিচয় দেয়। এভাবে কোথা থেকে টাকা জমা হচ্ছে, উত্তোলিত টাকা কে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তা বোঝার কোনো উপায় নেই। বরং অপরাধলব্ধ অর্থের উৎস গোপন করার লক্ষ্যে এ ধরনের লেনদেন করা হয়, যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
মামলার এজাহারে বলা হয়, অভিযুক্তরা পরস্পর যোগসাজশে ব্যাংকিং নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অপরাধলব্ধ ৯ কোটি ২৮ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ টাকা ব্যাংকে নগদ জমা করে পরে বর্ণিত অর্থের অবৈধ প্রকৃতি, উৎস, অবস্থান, মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ গোপন করার লক্ষ্যে জ্ঞাতসারে স্থানান্তর, হস্তান্তরপূর্বক লেয়ারিং করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অপরাধ করেছেন।
এ মামলার প্রধান আসামি রাশেদুল হক চিশতী দুদকের আরেক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।
এর আগে ফারমার্স ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনায় গত ১০ এপ্রিল অরেকটি মামলা করে দুদক। মামলায় চারজনের বিরুদ্ধে ১৬০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ আনা হয়। মামলা করার পরপরই চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন মাহবুবুল হক চিশতীসহ (বাবুল চিশতী), চিশতীর ছেলে রাশেদুল হক চিশতী, ব্যাংকের এসভিপি জিয়াউদ্দিন আহমেদ ও ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মাসুদুর রহমান খান।
ফারমার্স ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনাটি গত বছর থেকে অনুসন্ধান করছে দুদক। সে অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে মাহবুবুল হক চিশতী, তাঁর পরিবারের পাঁচ সদস্য, ব্যাংকের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তাসহ ১৭ জনের বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে গত এপ্রিলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে দুদক। ওই তালিকায় ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নাম ছিল না।
অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ তদন্তে ব্যাংকটির সাবেক দুই শীর্ষ ব্যক্তির অনিয়ম তুলে ধরা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকটির গ্রাহকের ঋণের ভাগ নিয়েছেন মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও মাহবুবুল হক চিশতী। এর মাধ্যমে দুজনের নৈতিক স্খলন ঘটেছে এবং তাঁরা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।

পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকটির জনবল নিয়োগ হয়েছে মূলত এ দুজনের সুপারিশেই। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে তাঁরা নিয়োগ দিয়েছেন। এ ছাড়া মাহবুবুল হক চিশতীর ছেলে রাশেদুল হক চিশতীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আরসিএল প্লাস্টিকের সঙ্গে ব্যাংকের গ্রাহকদের অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্যও বেরিয়ে আসে।

২০১২ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেওয়া ফারমার্স ব্যাংক কার্যক্রম শুরুর পরই অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে। আস্থার সংকট তৈরি হলে আমানতকারীদের অর্থ তোলার চাপ বাড়ে। পরিস্থিতির অবনতি হলে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে বাধ্য হন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী। পরিচালকের পদ থেকেও পদত্যাগ করেন তাঁরা।