তুমি একদিন আমাদের কাছে চুপটি করে এসো

মা লুৎফুন নাহার ও বাবা মাহতাবুল হাকিমের সঙ্গে ছেলে অদ্বিত। ছবি: সংগৃহীত
মা লুৎফুন নাহার ও বাবা মাহতাবুল হাকিমের সঙ্গে ছেলে অদ্বিত। ছবি: সংগৃহীত
>

লুৎফুন নাহার ও মাহতাবুল হাকিম দম্পতির দুই ছেলেমেয়ে। ছেলে অদ্বিত ছিল অটিস্টিক। এই ছেলেই ছিল বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের চোখের মণি। স্পিচথেরাপি দেওয়া হলে ১২ বছর বয়সে অদ্বিত প্রথম মা ডাকা শুরু করে। অদ্বিতের জন্ম ২০০৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর এক লিফট দুর্ঘটনায় মারা যায় অদ্বিত। তারপর থেকে পুরো পরিবারের কাছে পৃথিবীটা ধূসর হয়ে গেছে। ছেলের জন্মদিনে তার কাছে লেখা মা লুৎফুন নাহারের চিঠি।

আমার বাবু সোনা
এই চিঠি তোমার জন্য। কদিন থেকে তোমার ছোট আপু অথৈর খুব মন খারাপ! তোমাকে সে একটা চিঠি লিখেছে। ছোট একটা লাল বাক্স জোগাড় করেছে। তার মধ্যে তোমার একটা ছবি আর চিঠিটা রেখেছে। সেখানে লিখেছে ‘মাই ডিয়ারেস্ট ব্রাদার, উই মিস ইউ অ্যান্ড লাভ ইউ! ফ্রম ইওর ফ্যামিলি।’ এই বাক্স সে একদমই হাতছাড়া করে না। যেখানে যাচ্ছে সেখানেই নিয়ে যাচ্ছে। নিজে খাওয়ার সময় তোমাকে খাওয়াচ্ছে, তোমার ছবিকে গল্প পড়ে শোনাচ্ছে, তোমাকে চকলেট দিচ্ছে, এমনকি তোমাকে নিয়ে টিভি দেখছে। অনবরত তোমার সাথে কথা বলছে আর ঘুমানোর সময় বাক্সটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। আজ বাক্সটা স্কুলে নিয়ে গেছে।

কয়েক দিন ধরেই ঘুমানোর সময় তোমাকে মনে করে কাঁদছে। এ কান্না সহ্য করা বড় কঠিন, বাবা! আমাকে সে কত প্রশ্ন যে করছে! আমার কাছে কোনো উত্তর নেই, বাবা!

‘মা, ভাইয়া কি আর কোনো দিনও আসবে না আমাদের কাছে? আমি তো ভেবেছিলাম ও বড় হয়ে ফিরে আসবে! আল্লাহ ভাইয়াকে কেন নিয়ে গেল!’

আমি বললাম, আল্লাহ যাকে বেশি ভালোবাসে তাকে আগে নিয়ে নেয়। সে বলল, ‘ভাইয়া বেঁচে না থাকলে আমি বেঁচে থাকতে পারি না মা! আমি ভাইয়ার কাছে যেতে চাই, মা। আমি কবে যাব, মা?’ আমার ভেতরে কালবোশেখি ওঠে! কান্না লুকোনোর ব্যর্থ চেষ্টা যত! আমার চোখের জল তো ওকে আমি দেখাতে চাই না! কিন্তু অবিনাশী, দুর্নিবার সেই জলেই ভিজে যায় ওর রেশমি চুল!

আমার বাবু সোনা টুনটুন, তুমি কি আমাদের দেখতে পাও? শুনতে পাও আমাদের কষ্ট আর কান্নার শব্দ?

আমি এখন আর ওকে কোনো ঘুমপাড়ানি গান শোনাতে পারি না। ঘুমপাড়ানি গান ছাড়া তুমি ঘুমাতে না। সব গান যে তোমাকে শোনানো হয়ে গেছে! আমার গলা ধরে আসে আর চোখ ভিজে যায় গান গাইতে গেলে! আমি একদমই পারি না আর! তবু শুনতে চাইলে বলি, ‘এক দেশে ছিল এক বাদশাহ, সেই বাদশার ছিল এক বেগম, এক ফুটফুটে শাহজাদা ছিল তাদের...।’ আমাকে থামিয়ে দিয়ে অথৈ বলে, ‘মা, এই শাহজাদা কি আমার ভাইয়া?’ দেখি ওর দুচোখ ছলছল করে ওঠে।

দুই ছেলেমেয়ের সঙ্গে লুৎফুন নাহার ও মাহতাবুল হাকিম। ছবি: সংগৃহীত
দুই ছেলেমেয়ের সঙ্গে লুৎফুন নাহার ও মাহতাবুল হাকিম। ছবি: সংগৃহীত

কদিন আগে তোমাকে সে স্বপ্নে দেখেছে। দেখেছে, আমরা বোটানিক্যাল গার্ডেন বেড়াতে গেছি। তুমিও সেখানে এসেছ। (বোটানিক্যাল গার্ডেন যেখানে আমরা সবাই মিলে প্রতি ছুটির দিনে হাঁটতে যেতাম)। সকালে উঠে আমাকে প্রশ্ন করল, ‘মা, আমরা কেন আর বোটানিক্যাল গার্ডেন যাই না?’ আমি বললাম, ‘ভাইয়া যে যেত, তাই যাই না।’ ও বলল, ‘ভাইয়াও যাবে আমাদের সাথে, মা। ও একটা মেঘ হয়ে যাবে আমাদের সাথে!’ রাতে ঘুমানোর সময় কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘মা, ভাইয়া কি একটা মেঘ, না আকাশ হয়ে গেল?’

আমি জানি না বাবা তুমি কী হয়ে গেছ। তবে মনে হয় বাতাস, যাকে ছাড়া এক মুহূর্তও থাকা অসম্ভব। তুমি সেই বাতাস!

আমি কত দিন তোমার চুলের গন্ধ পাই না! তোমার শরীর কী মিষ্টি একটা গন্ধ ছিল! ঘুমানোর সময় তুমি বুকের কাছে একটা কুণ্ডলী হয়ে ঘুমাতে। কত দিন তোমাকে আমি জড়িয়ে ধরি না, বাবু সোনা! শেষ যেবার সবাই তোমাকে আমার কাছে নিয়ে এল, তখনো তুমি ঘুমাচ্ছিলে! আমার খুব ইচ্ছে করছিল তোমাকে ভীষণভাবে জড়িয়ে ধরি আর তোমার চুলের গন্ধ নিই, শরীরের গন্ধ নিই! কেউ আমাকে তোমাকে একটু ছুঁতে পর্যন্ত দেয়নি বাবা!

সেই দিনটির কথা আমরা ভুলতে পারি না। সেতারাস ড্রিম, ১/১১ পল্লবী। সেদিন ছিল ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫। আমার আর কেয়ারটেকারের সঙ্গে তুমি যাচ্ছিলে বোটানিক্যাল গার্ডেন। ১৪ তলা থেকে নিচে নামতে হবে। ভবনের দুটো লিফট পালাক্রমে চলে। যে লিফটটি চালু ছিল, সেটাতে কল দিলাম। কেয়ারটেকারের হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে থাকা তোমাকে ডাক দিলাম। তুমি (অদ্বিত ১২ বছর বয়স) দৌড়ে এসে পাশের বন্ধ থাকা লিফটটির দরজায় ধাক্কা দিলে। বন্ধ লিফটটির এক পাশের দরজা আশ্চর্যজনকভাবে বেঁকে ফাঁকা হয়ে গেল। ভারসাম্য হারিয়ে নিচে পড়ে গেলে তুমি। লিফটটি তখন ছিল নিচে। সঙ্গে সঙ্গে লিফটটির দরজাও অদ্ভুতভাবে বন্ধ হয়ে গেল। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে আধা ঘণ্টা পর তোমার দেহ উদ্ধার করল নিচে থাকা লিফটটির ছাদ থেকে। সবাই ছুটলাম হাসপাতালে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। তুমি ছিলে বাবা, মা, দাদা, দাদির চোখের মণি। মাত্র ১২ বছর বয়সে তোমার জীবন কেড়ে নিল ভয়ানক যন্ত্র লিফট!

তোমার স্কুলের (SWAC) ক্যাফেটেরিয়ার নামকরণ করেছে তোমার নামে, অদ্বিত ক্যাফে। আমার পছন্দের তোমার কিছু ছবি চেয়েছে ওরা। আমি কোন ছবি দেব বাবা, তোমার সব ছবিই তো আমার খুব প্রিয়।

আমি জানি না, কবে তোমার সাথে আমাদের আবার দেখা হবে! তবে তুমি একদিন আমাদের কাছে চুপটি করে এসো—কিছু না বাবা, তোমাকে শুধু একটু ছুঁয়ে দেখব আর একটু চুলের, গায়ের গন্ধ নেব, শুধু একবার, একটিবার এসো আমার বাবু সোনা টুনটুন...

তোমার মা
লুৎফুন নাহার