ভোটের আগে সবাইকে খুশি রাখার চেষ্টা

>
  • সড়ক আইন পাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের খুশি রাখার চেষ্টা
  • ব্যবসায়ীদের খুশি রাখতে ব্যাংকঋণের সুদের হার হ্রাস
  • পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ঘোষণা
  • শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ ও এমপিওভুক্তি
  • বিএনপিকে চাপে রেখে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছে আ. লীগ
  • বিএনপির দাবি বা কর্মসূচিতে ছাড় নেই

নির্বাচন ও ভোটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি সব পক্ষকেই খুশি রাখতে চায় সরকার। এ জন্য ক্ষমতার শেষ ভাগে চাকরিপ্রার্থী, শিক্ষার্থী, তরুণ, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের দাবি পূরণ করা হচ্ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সরকার একদিকে জনতুষ্টিমূলক বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়ে ভোটারদের আকৃষ্ট করতে চাইছে, অন্যদিকে উন্নয়নের প্রচার চালিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। তবে বিরোধী দলের কোনো দাবি সরকার শিগগিরই মানবে না। তাঁদের মতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগমুহূর্ত পর্যন্ত বিএনপিকে চাপে রাখা এবং দাবিদাওয়া নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যস্ত রাখাটাই সরকারি দলের কৌশল।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির শীর্ষ মহল নানা দাবি তুলে দর-কষাকষি করার চেষ্টা করছে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীরা কিন্তু নির্বাচনে নেমে পড়েছেন। দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদেরও উচিত আজগুবি ও অযৌক্তিক সব দাবি বাদ দিয়ে নির্বাচনের মাঠে নেমে পড়া। তিনি বলেন, ক্ষমতায় এসে জনগণের জন্য কাজ করার মূল পথ হচ্ছে নির্বাচন। ফলে নির্বাচন ও ভোটার মাথায় রেখে সরকার উন্নয়ন করবে, এটাই স্বাভাবিক।

সরকারের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চাকরিপ্রার্থী, তরুণ ও শিক্ষার্থীদের খুশি করতে কোটা বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কোটা আন্দোলনে জড়িত শিক্ষার্থীদের জামিন দেওয়া হয়েছে।

সড়ক পরিবহন আইন পাস করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে জড়িত শিক্ষার্থীদের খুশি রাখার চেষ্টা হয়েছে। এই আন্দোলনে জড়িতরাও জামিন পেয়েছেন। ২০১০ সালে সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও মালিক-শ্রমিকদের চাপে দীর্ঘদিন ধরেই তা আটকে ছিল। ২৯ জুলাই জাবালে নূর পরিবহনের বাসচাপায় রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। এরপর শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে সরকার আইনটি তড়িঘড়ি করে পাসের উদ্যোগ নেয়। এখন এটি পাসের অপেক্ষায় রয়েছে।

আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, তরুণ প্রজন্ম তাঁদের বড় শক্তি। ২০০৮ সালে দিনবদলের সনদ ও ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগান দিয়ে তরুণদের আকৃষ্ট করা গেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার এবং নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে পুলিশ ও ছাত্রলীগের ভূমিকা নিয়ে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছে।

সরকারি চাকরিতে ৯ম থেকে ১৩ তম গ্রেডে (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) কোটা না রাখতে গত সোমবার সুপারিশ করেছে সরকার গঠিত কমিটি। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, মুক্তিযোদ্ধা কোটা স্পর্শকাতর বিষয়। কিন্তু নির্বাচন মাথায় রেখে কোটা সংস্কারের বিষয়ে সরকার নমনীয়।

গত বৃহস্পতিবার পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ঘোষণা করা হয়েছে। সরকার, মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে মোটামুটি একটি সমঝোতার মাধ্যমে এই মজুরি ঘোষণা করা হয়েছে, যদিও শ্রমিকনেতারা মনে করেন, আট হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি বাজারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। সম্প্রতি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়া শ্রম আইনও মোটামুটি গ্রহণযোগ্য হয়েছে, এটি সংসদের চলতি অধিবেশনে পাস হতে পারে।

গত কয়েক মাসে দেশের বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় ৪০০ স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ করা হয়েছে। ভোটের আগে হাজারখানেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে।

গত বছর কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি মাস্টার্সের সমমান দেওয়া হয়। সংসদের চলতি অধিবেশনেই আইনটি পাস হবে। হেফাজতে ইসলামের নেতাদের বেশির ভাগই কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক। তাঁদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল এটি।

ব্যবসায়ীদের খুশি রাখতে ভোটের আগে বড় ধরনের ছাড় দিয়েছে সরকার। বাজেট পাসের ৭০ দিনের মাথায় ১০ সেপ্টেম্বর তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের উৎসে কর ও করপোরেট কর কমানো হয়েছে। এ ছাড়া ওষুধসহ ৯টি খাতে নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকঋণের সুদের হার এক অঙ্কে (সিঙ্গেল ডিজিট) রাখার চেষ্টা আছে সরকারের।

বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়টি ছলচাতুরী ছাড়া আর কিছুই নয় বলে মনে করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান। তিনি বলেন, এর মূল উদ্দেশ্য নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়া। সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছে। আর বিএনপিসহ বিরোধী দলের ওপর পুলিশকে লেলিয়ে দিয়েছে। এই অবস্থায় সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।

গত ১৫ মে থেকে সরকার মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করে। প্রথম আলোর হিসাবে গত সোমবার পর্যন্ত ২১৭ জন মারা গেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, তাঁরা সবাই মাদক ব্যবসায়ী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে কিংবা নিজেদের মধ্যে গোলাগুলিতে তাঁরা নিহত হন।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করা হয়েছে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে। দলের অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন ও নিজস্ব জরিপে এসেছে, মাদকের বিস্তার, দ্রব্যমূল্য ও দুর্নীতি নিয়ে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ আছে। এগুলো সরকারের ভালো কাজ ম্লান করে দিচ্ছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে দুর্নীতিবিরোধী কিছু অভিযানও মাঝেমধ্যে চলবে। এর মধ্যে সরকারি দলের কিছু নেতাও পড়বেন। দুর্নীতির অভিযোগ আছে এমন কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রী-সাংসদকে মনোনয়ন দেওয়া হবে না।

গত এক বছরে সাংসদদের জন্য চারটি প্রকল্প পাস করা হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য ২২ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা। সর্বশেষ ১১ সেপ্টেম্বর সাংসদদের পছন্দমতো নিজ নির্বাচনী এলাকায় মাদ্রাসা ভবন নির্মাণ, সম্প্রসারণ ও মেরামত বাবদ ৫ হাজার ৯১৫ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করেছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)।

জনতুষ্টির পাশাপাশি বিরোধীরা চাপে
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার, সংসদ ভেঙে নির্বাচন ও সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে ভোটের দায়িত্ব দেওয়াসহ বিএনপি যেসব দাবি করছে, এর একটাও মানার পরিকল্পনা নেই বলে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানায়। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তিরও তেমন সম্ভাবনা নেই।

আগামী দিনগুলোতে বিএনপির ওপর চাপ আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিরোধী দলের নেতারা। তাঁরা নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার এড়িয়ে চলতে পরামর্শ দিয়েছেন। আন্দোলন সংগঠিত করার মতো নেতারা ইতিমধ্যে চাপের মুখে আছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন তলব করেছে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে, গতকাল রাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন দলের যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান। দেশের বিভিন্ন এলাকায় গায়েবি মামলা দিচ্ছে পুলিশ।

এরই মধ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণার তারিখ এসেছে ১০ অক্টোবর। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই মামলার অন্যতম আসামি। রাজনৈতিক মহলের গুঞ্জন হচ্ছে, বড় ধরনের শাস্তির মুখে পড়তে পারেন তারেক। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা তারেকের ফাঁসি দাবি করেছেন, কেউবা বলছেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। একদিকে অসুস্থ খালেদা জিয়ার কারাগারে থাকা, আরেক দিকে তারেক রহমানের আরও সাজা হওয়ার আশঙ্কা রাজনীতিতে নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত আগস্ট মাসে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ২১ আগস্ট মামলার সাজা ঘোষণার পর সংকটে পড়বে বিএনপি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দাবি বাস্তবায়ন কিংবা ভোটের হাওয়া নিজেদের পক্ষে আনার জন্য মাঠে নেমে জনমত গঠনের সুযোগ বিএনপিকে দেওয়া হবে না। এর বাইরে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে বিএনপি। এটাকে আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন ‘নেতিবাচক’ প্রচার। এর পাল্টা হিসেবে সরকার কূটনৈতিক স্তরে ও রাজনৈতিকভাবে ‘ইতিবাচক’ প্রচার শুরু করেছে। সরকারের উন্নয়নের প্রচারেই ৩০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের অন্যতম মুখপাত্র মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, সরকার ক্ষমতায় এসেছে মানুষের উন্নয়ন করার জন্য। সেটাই করছে। বিএনপিকে ব্যস্ত রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, বিএনপি নিজেদের কৌশল নিয়ে ব্যস্ত। আগেরবার তারা ভোট না করে তা ঠেকাতে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। এবার তাদের পরিকল্পনা তারাই বলতে পারবে।

১৫ সেপ্টেম্বর নীলসাগর ট্রেনে করে ঢাকা থেকে নীলফামারী পর্যন্ত ‘নির্বাচনী যাত্রা’ করেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। এই যাত্রায় ১৬টি স্টেশনে বিপুল জমায়েতের চেষ্টা করা হয়। আগামী সপ্তাহে সড়কপথে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা চট্টগ্রাম অঞ্চলে একাধিক সভা করবেন। এরপর নৌপথেও নির্বাচনী যাত্রা করার পরিকল্পনা আছে তাঁদের।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দেখা গেছে একটা নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠান। আগামী জাতীয় নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ সেটা করতে চাইছে। এর জন্য বিরোধীরা যাতে সমপ্রতিদ্বন্দ্বিতার অবস্থায় আসতে না পারে, সে জন্য তাদের নানা আইনি ও প্রশাসনিক বাধার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এর পেছনেই ছুটতে ছুটতে নির্বাচন চলে আসবে। ফলে বিরোধীরা আর পেরে উঠবে না। জনগণকে খুশি করার নানা উদ্যোগ বাড়তি সতর্কতার অংশ হিসেবে নেওয়া হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।