মিরপুরের ডেঙ্গু রোগী বেশি

মিরপুরের পূর্ব শেওড়াপাড়ার নওরীন খান (৭) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে শিশু হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। গতকালের ছবি। প্রথম আলো
মিরপুরের পূর্ব শেওড়াপাড়ার নওরীন খান (৭) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে শিশু হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। গতকালের ছবি। প্রথম আলো

ঢাকা শিশু হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুদের অধিকাংশই মিরপুরের। এই হাসপাতালে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া তিনজনের একটি শিশু মিরপুর এলাকার।

এ বছরের ৪ জুলাই থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া শিশুদের তথ্য বিশ্লেষণে এই চিত্র উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসা ৬৫ শতাংশ শিশু মিরপুরের। এ সময় হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে ২৫১টি শিশু।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, রাজধানীতে চলতি বছরের প্রথম আট মাসে প্রায় তিন হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ১১ জন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, পাশাপাশি ডেঙ্গুর ভয়াবহতাও আগের তুলনায় বেড়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার শেরেবাংলা নগরের এ হাসপাতালের ১ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, নওরীন খানকে (৭) দুপুরের খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন তার মা। কিন্তু মেয়েটি কিছুতেই মুখে খাবার তুলছে না। শরীর দুর্বল, দ্রুত ওজন হারাচ্ছে নওরীন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সাত দিন ধরে এই হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে শিশুটির। নওরীনের পরিবার মিরপুরের পূর্ব শেওড়াপাড়ায় থাকে।

আবার ১১ মাসের ইমরান হোসেন পাঁচ দিন ধরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। শিশুটির হাতে স্যালাইন, থেকে থেকে চিৎকার করছে। কিছুতেই মা শান্ত করতে পারছেন না। ইমরানের পরিবার মিরপুর ৭ নম্বরের বাসিন্দা।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসির) পাঁচটি অঞ্চল। এর মধ্যে ২ ও ৪ নম্বর অঞ্চল নিয়ে মিরপুর এলাকা। ডিএনসিসির হিসাবমতো, ৩৩ দশমিক ৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মিরপুরে হোল্ডিং সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫২ হাজার। এখানেই এবার বেশিসংখ্যক শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাকির হাসান বলেন, ‘এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের নিজস্ব জরিপ না থাকায় সুনির্দিষ্ট কারণ বলা কঠিন। তবে মিরপুর রাজধানীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। এখানে বস্তির সংখ্যাও অনেক। পাশাপাশি মিরপুরে বর্তমানে নির্মাণকাজ অন্য এলাকার চেয়ে বেশি হচ্ছে। নির্মাণাধীন ভবন মশা উৎপাদনের একটি বড় স্থল। এসব কারণে এই এলাকায় ডেঙ্গু–আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হতে পারে।’

ঢাকা শিশু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, গত বছর হাসপাতালে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১১৫টি শিশু চিকিৎসা নিয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ রোগী এসেছে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে। কোনো মৃত্যুর ঘটনা ছিল না। কিন্তু এ বছর গতকাল পর্যন্ত আড়াই শতাধিক শিশু চিকিৎসা নিয়েছে। এরা সবাই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। এর মধ্যে তিনটি শিশু মারা গেছে। রাজধানীর পাশাপাশি সারা দেশ থেকেই রোগী আসছে। বর্তমানে ৩৯টি শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। হাসপাতালের মোট শয্যার সংখ্যা ৬৫০।

হাসপাতালের পরিচালক আবদুল আজিজ বলেন, রাজধানীসহ সারা দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। পাশাপাশি ডেঙ্গুর ভয়াবহতাও আগের তুলনায় বেড়েছে। আগে কেবল ডেঙ্গু-১ এবং ডেঙ্গু-২ তে আক্রান্ত হয়ে রোগী এলেও এ বছর ডেঙ্গু-৩ তে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে।

জানা গেছে, চার ধরনের ডেঙ্গুর মধ্যে ডেঙ্গু-১ এবং ডেঙ্গু-২তে মৃত্যুঝুঁকি নেই বললেই চলে। কয়েক দিনের চিকিৎসায় সেরে যায়। ডেঙ্গু-৩ তে মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে। তবে এখনো ডেঙ্গু-৪ তে আক্রান্ত কোনো রোগী এখনো পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি।

হাসপাতালের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুদের অধিকাংশই ১০ বছরের নিচে। তবে ৩ থেকে ৯ বছর বয়সী শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। আবার রোগীদের মধ্যে ছেলেশিশুর সংখ্যা মেয়েদের তুলনায় অনেক বেশি। হাসপাতালের পরিচালক আবদুল আজিজ বলেন, শিশুদের উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর, বমি বমি ভাব বা বমি, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত গেলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। পাশাপাশি ডেঙ্গু মৌসুমি অসুখ হওয়ায় প্রতিরোধের দিকে গুরুত্বারোপ করতে হবে।

হাসপাতালের এপিডেমিওলজিস্ট কিংকর ঘোষ জানান, এ বছর এক দিনে সর্বোচ্চ ৫৯টি শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ডেঙ্গু চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় এর প্রভাব ফেলেছে। পরিস্থিতি সামলাতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ ১৬ সদস্যের ডেঙ্গু সেল তৈরি করেছে। ৬০ জন চিকিৎসককে ডেঙ্গু বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।