তপ্ত নগরে স্বস্তির ছায়া

সবুজে ছাওয়া ছোট্ট পার্কটি এলাকাবাসীর সকাল–বিকেল বেড়ানোর অন্যতম জায়গা। গতকাল মোহাম্মদপুরের বিজলী মহল্লায়।  প্রথম আলো
সবুজে ছাওয়া ছোট্ট পার্কটি এলাকাবাসীর সকাল–বিকেল বেড়ানোর অন্যতম জায়গা। গতকাল মোহাম্মদপুরের বিজলী মহল্লায়। প্রথম আলো

নানা প্রজাতির গাছগাছালিতে ছাওয়া ছোট্ট পার্কটির সর্বত্র যত্নের ছাপ। বসার বেঞ্চ থেকে হাঁটার পথ, ময়লা ফেলার পাত্র—সবকিছুই পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম। আশ্বিন মাসের অসহ্য রোদে চারপাশ যখন পুড়ছে, তখন অপরিসর এই পার্কটিতে ঢুকতেই পাওয়া গেল স্বস্তির ছোঁয়া। কানে এল পাখির কলকাকলি।

মোহাম্মদপুরের বিজলী মহল্লার পার্কটির বয়স খুব বেশি নয়। কিন্তু ভূমিদস্যুদের হাত থেকে ছোট্ট এই পার্কের জায়গাটুকু বাঁচাতে মহল্লাবাসীর সম্মিলিত লড়াইয়ের ইতিহাস দিয়েছে আলাদা মাত্রা।

বছর দেড়েক আগে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) উদ্যোগে নির্মিত পার্কটি দৈর্ঘ্যে ৮৭ মিটার, প্রস্থে বড়জোর ১০ মিটার। এটির উদ্বোধন করেছিলেন ডিএনসিসির প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। বিজলী মহল্লার যে জায়গায় পার্কটির অবস্থান, সেটি এখন জান্নাতবাগ বাই লেন নামে পরিচিত। এর অদূরেই জহুরি মহল্লা, জেনেভা ক্যাম্প। এটি ডিএনসিসির ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাভুক্ত।

মহল্লার বাসিন্দারা জানান, একসময় উন্মুক্ত জায়গাটি মহল্লার শিশু-কিশোরদের খেলার জায়গা ছিল। জায়গাটিকে সুশীতল করে তুলতে মহল্লাবাসীর প্রত্যেকে নিজ নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগান। কিন্তু একসময় জায়গাটির ওপর ভূমিদস্যুদের নজর পড়ে। এটি দখলে নিয়ে তারা প্লট বানিয়ে বিক্রি করতে চেয়েছিল। কিন্তু মহল্লার বাসিন্দাদের তীব্র বিরোধিতার মুখে তারা সফল হয়নি। সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের কাছ থেকে তাঁরা এখানে একটি পার্ক স্থাপনের প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেন। যার ধারাবাহিকতায় বর্তমান কাউন্সিলর মো. নুরুল ইসলাম রতন পার্কটি নির্মাণে উদ্যোগী হন। নামকরণ করা হয় ‘জান্নাতবাগ সবুজ চত্বর’।

এখন পার্কটি রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছে ডিএনসিসি। কিন্তু সেই কাজে নিজেদেরও যুক্ত করে নিয়েছে মহল্লাবাসী। কেউ নতুন লাগানো গাছগুলোতে নিয়ম করে পানি দেন, কখনো কখনো আবর্জনা পরিষ্কারের কাজে হাত লাগান। পার্কটিতে যেহেতু কোনো নিরাপত্তাপ্রহরী নেই, তাই সবাই মিলেই এর নিরাপত্তা বিধানের কাজ করেন। পার্কটি এখন এলাকার সব বয়সী মানুষের সময় কাটানোর প্রিয় জায়গা। এমনকি রাতের বেলায়ও এখানে নারী-শিশুরা নির্বিঘ্নে, নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারে।

পার্কটিতে আছে নানা জাতের গাছের সমাহার। নারকেলগাছের সঙ্গে আছে আম, জাম, কাঁঠাল, মেহগনি, বকুল, দেবদারু ও কৃষ্ণচূড়া। মাঝে মাঝে চায়না বেলি ও হাসনাহেনার ঝাড়। কিন্তু নতুন এই পার্কে এত পুরোনো গাছ কীভাবে এল?—এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন তরুণ আহমেদ আলী শেখ। পার্কের কয়েক হাত দূরত্বেই তাঁর বাড়ি। তিনি বলেন, ‘পার্কের এই গাছগুলো মহল্লার কারও না কারও হাতে লাগানো। পার্কটি যখন তৈরি হয়, তখন আমাদের প্রধান শর্ত ছিল, গাছগুলো রেখেই পার্কটি বানাতে হবে।’

আহমেদ আলীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে সেখানে হাজির হন সালাউদ্দিন বাদল ও কামরুল হাসান নামের আরও দুই তরুণ। তাঁদের সবার কাছ থেকেই জানা যায় পার্কের এই জায়গাটুকু রক্ষায় মহল্লাবাসীর এগিয়ে আসার গল্প। সালাউদ্দিন বলেন, ‘এই জায়গাটি বাঁচাতে আমাদের বাপ-চাচারা তাঁদের সর্বোচ্চটা করেছেন। মহল্লার নারীরা এগিয়ে এসেছেন সবার আগে।’

কামরুল হাসান বলেন, এই পার্কে কেউ ময়লা ফেলতে পারে না। রাতে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা আছে। মেয়েরাও এখানে নির্বিঘ্নে ঘোরাফেরা করতে পারে। স্কুলের বাচ্চারা আসে, আশপাশের মহল্লার লোকেরা আসে। পার্কটি যাতে নোংরা না হয়, সে ব্যাপারে সবাই নজর রাখে।

সার্বিক বিষয়ে কথা হয় মহল্লার বাসিন্দা হামিদুর রহমান ভূঁইয়ার (৮৬) সঙ্গে। অবসরে থাকা সাবেক এই প্রকৌশলী বলেন, ‘জায়গাটি দখল করে যখন প্লট বানানোর ষড়যন্ত্র চলছিল, তখন আমরা পরিবেশ আদালতে মামলা করি। মহল্লার সবাই সেই মামলা চালানোর খরচ জুগিয়েছেন। একসঙ্গে রুখে দাঁড়িয়েছেন।’

পার্ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দিকে নজর রাখার জন্য বর্তমান কাউন্সিলর নুরুল ইসলামের প্রশংসা করেন এই জ্যেষ্ঠ নাগরিক। তাঁর দাবি, পার্কের জন্য সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে একজন সার্বক্ষণিক মালি ও নিরাপত্তাপ্রহরী নিয়োগ দেওয়া হোক।

হামিদুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, এই মহল্লার বাসিন্দাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক খুবই দারুণ। সামাজিক বন্ধনও দৃঢ়।