যেভাবে ধরা পড়ল 'খাট'

  • মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী খাট বাংলাদেশে নিষিদ্ধ
  • খাট ইথিওপিয়ার উঁচু ভূমিতে জন্মানো একধরনের উদ্ভিদের পাতা
  • ৩১ আগস্ট ঢাকায় প্রথম খাটের চালান ধরা পড়ে
  • গ্রিন টির নামে কয়েক বছর ধরে ‘খাট’ আসছে বলে ধারণা
  • বাংলাদেশ মূলত ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে
  • এখান থেকে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে

ঘটনার সূত্রপাত গত আগস্টের শেষ দিকে। যুক্তরাষ্ট্রের ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ডিইএ) থেকে জানতে চাওয়া হয়, ‘খাট’ নামের মাদক বাংলাদেশে নিষিদ্ধ কি না? ইথিওপিয়া থেকে যার একটি চালান এখন ঢাকার পথে। ঢাকা চাইলে তারা পথে চালানটি জব্দ করবে। তখন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ডিইএকে জানায়, তারা খাটের চালান ও চালানের মালিককে ধরতে চায়। এরপর ঢাকায় ধরা পড়তে থাকল একের পর এক খাটের চালান।

খাট উদ্ধার অভিযানে যুক্ত ছিলেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা শাখার অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম সিকদার। গতকাল বুধবার তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল খাট উদ্ধারের পেছনের কাহিনি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী খাট বাংলাদেশে নিষিদ্ধ, যাকে বলা হচ্ছে নিউ সাইকোট্রফিক সাবসটেনসেস (এনপিএস)। খাট হচ্ছে ইথিওপিয়ার উঁচু ভূমিতে জন্মানো একধরনের উদ্ভিদের পাতা।

ডিইএর খবর অনুযায়ী, খাটের চালানটি ২৭ আগস্ট ঢাকায় এসে পৌঁছানোর কথা ছিল। বিমানপথে রুট ইথিওপিয়া-সিঙ্গাপুর-সংযুক্ত আরব আমিরাত-ভারত-ঢাকা। কিন্তু সেদিন এল না। কর্মকর্তাদের ধারণা হয়, চালানের রুট পরিবর্তন হয়েছিল। সিঙ্গাপুর বা ভারতে কয়েক দিন ছিল চালানটি। চালানটি শেষ পর্যন্ত ঢাকায় পৌঁছায় ৩১ আগস্ট। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ফরেন পোস্ট অফিস এলাকা থেকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর খাট জব্দ করে। গ্রেপ্তার হন মো. নাজিম নামের এক ব্যক্তি। তিনি জিজ্ঞাসাবাদে জানান, আরও তিন টন খাট বাংলাদেশের পথে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ধারণা, ৩১ আগস্টেই প্রথম খাটের চালান বাংলাদেশে এসেছে বিষয়টা এমন নয়। ‘গ্রিন টি’র ঘোষণা দিয়ে খাট বাংলাদেশে আসছে কয়েক বছর ধরেই। এখানে ‘হারবাল মেডিসিন’ হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হতে পারে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, যাঁরা খাট আনছেন, তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, বাংলাদেশ মূলত ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখান থেকে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে। এ পর্যন্ত ২০টি প্রতিষ্ঠানের নাম জানতে পেরেছেন তাঁরা; যাদের মাধ্যমে খাট আসে। তবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই ভুয়া নাম ব্যবহার করেছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা শাখার অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম সিকদার জানান, ডিইএ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে চালান আসার আগাম খবর দেওয়ার পাশাপাশি একটি ঠিকানাও দিয়েছিল। নাওয়াহীন এন্টারপ্রাইজ, শান্তিনগর। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ঠিকানা ধরে পৌঁছালেন ঠিকই, কিন্তু ওই নামের প্রতিষ্ঠান আর খুঁজে পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল নওশীন এন্টারপ্রাইজ নামের একটি দোকান। তবে অন্ধকারাচ্ছন্ন গলির ভেতর দোতলা বাড়িতে থাকা প্রতিষ্ঠানটিকে খোলা পাওয়া যাচ্ছিল না। একদিন বেশ রাতের দিকে দোকানটা খুলতে দেখা গেল। দুজন লোককেও পাওয়া গেল। জানালেন তাঁদের গ্রিন টির কারবার। কিন্তু কিছুতেই দোকানমালিকের নাম বলতে চাইলেন না। এর মধ্যেই একদিন দুই নারী এলেন দোকান থেকে তাঁদের মালামাল বুঝে নিতে। তাঁদের থেকে জানা গেল, দোকানমালিকের নাম মো. নাজিম। ফোন নম্বর জোগাড় হলো। ক্রেতা সেজে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লোকজন গ্রিন টি কিনতে চাইলেন। মালিক প্রথমে পাত্তাই দেননি। অনেক অনুরোধের পর ১৫ হাজার টাকা কেজিতে কিছু গ্রিন টি বিক্রি করলেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন, মো. নাজিম ২৫-২৬ বছর দুবাইতে ছিলেন। ওখানে তাঁর বিজ্ঞাপনী সংস্থা ও ছাপাখানা ছিল। সেখানে তাঁর পাশের দোকান ছিল ইথিওপিয়ার এক ব্যবসায়ীর। ২০১৬ সালে মো. নাজিম বাংলাদেশে আসেন। ধারণা করা হচ্ছে, তখন থেকেই এই ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ইথিওপিয়া থেকে এনে মো. নাজিম ঢাকা থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাট পাঠান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ও বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক আ ব ম ফারুক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক অর্থে খাট ইয়াবার চেয়েও খারাপ। যারা খাট সেবন করে তাদের অনিদ্রা হয়, ক্ষুধামান্দ্য হয়, বোধবুদ্ধি লোপ করে দেয়। রাতের পর রাত জেগে থাকলেও খাট সেবনকারীরা বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো কাজ করতে পারে না।’

কখন, কোথায় খাট প্রথম ব্যবহৃত হয়েছে, তার হদিস জানা যায়নি। তবে জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক সংস্থার (ইউএনওডিসি) ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ১৪ শতকের একটি পাণ্ডুলিপিতে খাটের উল্লেখ আছে। উত্তর আফ্রিকা ও আরবে স্বল্পমাত্রার খাট ওষুধ হিসেবে আবার উৎসবের অনুষঙ্গ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে।