'বৃক্ষমানবের' জিন শনাক্ত

শাহানা খাতুন
শাহানা খাতুন
>

• ট্রি ম্যান সিনড্রোম অতি বিরল রোগ
• রোগটির সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই
• এএনকেআরডি ২৬ নামের জিন রূপান্তরে রোগ
• জিন শনাক্ত হওয়ায় চিকিৎসার সম্ভাবনা

হাতে, পায়ে ও মুখে শিকড়ের মতো বস্তু নিয়ে ঢাকা মেডিকেল চিকিৎসা নিতে আসা কিছু রোগী ‘বৃক্ষমানব’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, এটা জিনগত রোগ, জিনের রূপান্তরের কারণে এই ‘শিকড়’ জন্মেছে। সম্প্রতি দেশি-বিদেশি একদল গবেষক শিকড়ের মতো এই বস্তুর জন্য দায়ী সুনির্দিষ্ট জিনকে চিহ্নিত করেছেন।

সব জিনের অনুক্রম বা হোল জিন সিকোয়েন্সের মাধ্যমে গবেষকেরা দেখেছেন, এএনকেআরডি২৬ নামের জিনে পরিবর্তন হওয়ায় ত্বকের কোষ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে শিকড়ের মতো হয়। ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হওয়া শাহানা খাতুন নামের এক রোগীর রক্ত ও টিস্যু পরীক্ষা করে তাঁরা এই জিন চিহ্নিত করেছেন। এর ফলে ভবিষ্যতে বৃক্ষমানব বা ট্রি ম্যান সিনড্রোম থাকা রোগীর সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে বলে আশা করছেন গবেষকেরা।

হাত-পায়ে শিকড়ের মতো বস্তু নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আলোচিত হয়েছিলেন খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার আবুল বাজনদার। আবুল ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয়েছিলেন ২০১৬ সালের ৩০ জানুয়ারি। বার্ন ইউনিটের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রায় এক বছর পর ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে একই ইউনিটে ভর্তি হয়েছিল নেত্রকোনার শাহানা খাতুন। তার বয়স ছিল ১০-১১ বছর। ওই সময় বগুড়ার একই পরিবারের একাধিক সদস্য এই রোগে আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছিল। তবে কারও চিকিৎসা শেষ করতে পারেনি ঢাকা মেডিকেল। এই রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসাও নেই।

কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরীক্ষাগারে আবুল বাজনদারের রক্ত ও টিস্যু পাঠানো হয়েছিল। সেখান থেকে আবুলের সমস্যাটি জিনগত ত্রুটি বলে জানানো হয়েছে। তবে আবুলের জিন অনুক্রম হয়নি।

বার্ন ইউনিটের সমন্বয়কারী সামান্ত লাল সেন প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের শুরুর দিকে নেত্রকোনা থেকে শাহানা ট্রি ম্যান সিনড্রম নিয়ে এসেছিল। বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য ও কানাডার ১১ জন চিকিৎসক ও গবেষক শাহানার সব জিন বিশ্লেষণের (হোল জেনম সিকোয়েন্স) উদ্যোগ নেন। তাতে তাঁরা দেখেছেন, এএনকেআরডি২৬ নামের জিন রূপান্তরিত হয়েছিল বলে শাহানা ‘বৃক্ষমানব লক্ষণে’ আক্রান্ত হয়।

এই গবেষক দলের নেতৃত্বে ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশি জিনবিজ্ঞানী কানাডার টরন্টোর সিক চিলড্রেন হাসপাতালের সেন্টার ফর অ্যাপ্লায়েড জিনোমিকসের সহযোগী বিজ্ঞানী মোহাম্মদ উদ্দিন। অন্যদের মধ্যে ছিলেন ঢাকার হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের প্রাণরসায়ন বিভাগের প্রভাষক কে এম ফোরকান উদ্দিন, ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. রুবেদ আমিন, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সহযোগী বিজ্ঞানী মোহাম্মদ আবদুল আলিম, ঢাকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিউরোজেন টেকনোলজির হোসনে আরা আখতার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, যুক্তরাজ্যের নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সের উডবারি স্মিথ, কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলকুলার জেনেটিকস বিভাগের স্টিফেন সেরার। বৃক্ষমানবের জিন শনাক্তকরণ নিয়ে একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ এ বছর জুনে যুক্তরাষ্ট্রের উইলি প্রকাশনার ক্লিনিক্যাল কেস রিপোর্টসে প্রকাশিত হয়েছে।

চিকিৎসক ও গবেষকেরা বলছেন, ‘বৃক্ষমানব লক্ষণ’ বা এপিডার্মোডিসপ্লাসিয়া ভেরুসিফরমিস একটি বিরল রোগ। এটা ত্বকের রোগ, এতে ত্বকের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে, বিশেষ করে হাতের ও পায়ের আঙুল বৃদ্ধি পেয়ে গাছের শিকড়ের আকার নেয়। মানুষের ত্বকের সংস্পর্শে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস আসার পর এই রোগ দেখা দেয়।

গবেষক দলের সদস্য কে এম ফোরকান উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, জিন মানুষের শারীরিক ও মানসিক গঠন এবং নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। এএনকেআরডি২৬ জিনটি রোগব্যাধি থেকে ত্বককে নিরাপত্তা দেয়। কিন্তু এই জিন রূপান্তরিত হলে সেই নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তখনই ত্বক হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। শাহানার সমস্ত জিন পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এএনকেআরডি২৬ জিনে রূপান্তর ঘটেছে।

শাহানার জিনের রূপান্তর তার মা ও বাবার কারণে নাকি পরিবেশগত কারণে হয়েছে, সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন। বিজ্ঞানীরা শাহানার বাবার জিন পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছেন।

তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, শুধু যে এএনকেআরডি২৬ জিনের রূপান্তরের কারণে ত্বক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তা নয়। এভার১ ও এভার২ নামের দুটি জিনের রূপান্তরের কারণেও এটা হতে পারে।

আবুল বাজনদার ও শাহানার চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ এম ইউ কবির চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বৃক্ষমানবের জিন শনাক্তকরণের কাজটি নিঃসন্দেহে বড় অগ্রগতি। এখন এই রোগের সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা সম্ভব হবে।