বিনা খরচায় মধ্যাহ্নভোজ

নিম্ন আয়ের মানুষদের মধ্যে দুপুরের খাবার বিতরণ করা হচ্ছে । ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
নিম্ন আয়ের মানুষদের মধ্যে দুপুরের খাবার বিতরণ করা হচ্ছে । ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
>
  • প্রতিদিন দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে শুরু হয়ে যায় খাবার বিতরণ
  • আনুমানিক দুই হাজার লোক প্রতিদিন খেতে আসেন এখানে
  • মেহমানখানায় আসতে বাধা নেই কারোরই
  • খাদ্য বিতরণ চলছে ২০১২ সালের শেষ দিক থেকে
  • মেহমানদারির আয়োজক আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের চেয়ারম্যান

বেলা একটা। ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডের ১৫ নম্বর বাসস্ট্যান্ড থেকে শংকর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত রাস্তার পাশে সারি সারি রিকশা, তবে যাত্রী নেই। চালকেরাই যাত্রীর আসনে বসে খিচুড়ি খাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার আসনটি সড়কে পেতে নিয়ে গল্প করতে করতে খাবার খাচ্ছেন।

মধ্যাহ্নভোজের এই চমকপ্রদ দৃশ্য সড়কটির ৭৬৪ নম্বর বাড়ির সামনে রোজ দুপুরে ঘণ্টা কয়েকের জন্য চোখে পড়বে। বিনা খরচায় আয়োজনটি মূলত নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য, তবে এই মেহমানখানায় আসতে বাধা নেই কারোরই। এই খাদ্য বিতরণ চলছে ২০১২ সালের শেষ দিক থেকে। ঝড়বৃষ্টি যা-ই থাক, প্রতিদিন দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে শুরু হয়ে যায় খাবার বিতরণ। আনুমানিক দুই হাজার লোক প্রতিদিন খেতে আসেন এখানে। এই মেহমানদারির আয়োজন করেছেন আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এম এনামুল হক।

গতকাল বুধবার রিকশাচালক মোফাজ্জল হোসেন খিচুড়ি খেতে খেতে বললেন, ‘দুফারের খাওন রোজ এইহানেই খাই। খিচুড়িডা খাইতে মজা। আর যতডুক খাইতে পারি, তার থিকাও অনেক বেশি দেয়।’ তিনি জানালেন, যাত্রী নিয়ে শহরের বিভিন্ন এলাকায় যেতে হয়, তবে দুপুরের খাবার যেন এখানে খেতে পারেন, সেটি বিবেচনা করে এই এলাকার আশপাশেই দুপুরের যাত্রী নেন।

একই রকম অভিজ্ঞতার কথা বলেন কমপক্ষে ১০ জন রিকশাচালক। তাঁরা এখানেই নিয়মিত দুপুরের খাবার খান। রায়েরবাজারের রিকশাচালক আলামিন খাওয়া শেষে পরিবারের জন্য নিয়েও খিচুড়ি নিয়ে গেলেন প্লাস্টিকের বাটিতে।

গতকাল দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, প্লেট-বাটি হাতে সারিতে দাঁড়িয়েছেন নানান বয়সী মানুষ। তাঁদের মধ্যে রিকশাচালক ছাড়াও আছেন নারী গৃহকর্মী, বিভিন্ন অফিসে কর্মরত নিম্নপদের কর্মচারী, বহুতল ভবন বা বাণিজ্যিক ভবনের নিরাপত্তাকর্মী, দোকান কর্মচারী এমনকি আশপাশের হাসপাতালে ভর্তি থাকা অনেক রোগীর আত্মীয়রাও ছিলেন তাঁদের মধ্যে। আর বড় বড় ডেক থেকে ভাপ ওঠা গরম খিচুড়ি তুলে দিচ্ছিলেন আল-হেলাল। তিনি জানান, অনেক সময় কৌতূহলী হয়ে এই এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বা পথচলতি সচ্ছল পরিবারের সদস্যরাও খিচুড়ি চেখে দেখতে আসেন। তিনি জানান, রোজ আট ডেক খিচুড়ি রান্না হয়। খেতে পারেন আনুমানিক দুই হাজার লোক। পরিবেশন শুরু হয় দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে। মোটামুটি আড়াই থেকে তিনটার মধ্যে বিতরণ শেষ হয়ে যায়। এখানে রায়েরবাজার, মোহাম্মদপুর ও শ্যামলী এলাকার লোকজনই মূলত আসেন। অনেক দূর থেকেও আসেন কেউ কেউ।

বেলা দুইটা নাগাদ পাশের একটি ব্যাংকের নিরাপত্তাকর্মী লুৎফর রহমান এলেন একটি বেশ বড় বাটি হাতে করে। তিনি জানালেন, তাঁর আরও দুই সহকর্মী দায়িত্বরত রয়েছেন। তিনি এসেছেন তিনজনের খাবার নিতে। প্রায় দুই বছর ধরে তাঁদের তিনজনের এখান থেকেই দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা হচ্ছে। যাঁর যেদিন সুযোগ হয়, সেদিন তিনি খাবার নিতে আসেন।

বিতরণকারীরা জানালেন, দুপুর ১২টার পর থেকেই খাবারের জন্য সারি পড়ে। যাদের থালাবাসন নেই, তাদের জন্য থালা আর গ্লাসও আছে। পানির ব্যবস্থাও আছে।

সেলিনা খাতুন শংকরের কয়েকটি বাসায় ছুটা বুয়ার কাজ করেন। তিনি প্রতিদিন এখানে নিজে খেয়ে বাড়িতে ছেলে-মেয়েদের জন্যও নিয়ে যান। তিনি বললেন, ‘খাবারটা খুব স্বাদের। গরম খিচুড়িতে মাংস থাকে। পোলাপানেরা মজা করে খায়। আমার খরচও বাঁচে।’

আয়োজকেরা জানালেন, এই খিচুড়ি রান্না হয় ধানমন্ডি ১০ নম্বরে। রান্নার আয়োজন শুরু হয় সকাল সাতটার পরেই। আটজন বাবুর্চি রান্না করেন। পরিবেশনও করেন তাঁরাই। বাবুর্চি আল-হেলাল জানান, চাল, ডাল, লাউ, কুমড়া, পেঁপে, টমেটো, গাজর, ধনেপাতা—এসব মৌসুমি সবজির সঙ্গে ৫০ কেজি মুরগির মাংস মিলিয়ে একটু নরম করে এই খিচুড়ি রান্না করা হয়।

আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের হেড অব মিডিয়া গাজী আহমেদ উল্লাহ জানালেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তেই এই আয়োজন। অনেকভাবেই মানুষকে সাহায্য করা যায়। তবে ক্ষুধার্ত মানুষকে খেতে দেওয়ার বিষয়টি তিনি পছন্দ করেন। সেই থেকেই এই উদ্যোগ। তবে এটা নিয়ে প্রচারে তাঁদের আগ্রহ নেই। প্রথমে শুরু হয়েছিল শুধু শুক্রবার দুপুরে খাবার বিতরণের মধ্য দিয়ে। পরে নিয়মিত প্রতিদিন করা হয়। শুরুতে ভাত, তরকারি, সঙ্গে গরুর মাংসের ব্যবস্থা ছিল। তবে ব্যবস্থাপনা সহজ করা এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের কথা বিবেচনা করে এই খিচুড়ির মেনু নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে উৎসবের দিনগুলোতে বিরিয়ানি বা মোরগ-পোলাওয়ের ব্যবস্থা থাকে।