ফ্রেন্ডস ক্লাবের দখলে রাজউকের মাঠ

উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টর খেলার মাঠের ফটকে বড় করে উত্তরা ফ্রেন্ডস ক্লাবের নাম লেখা রয়েছে। সম্প্রতি তোলা ছবি।  প্রথম আলো
উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টর খেলার মাঠের ফটকে বড় করে উত্তরা ফ্রেন্ডস ক্লাবের নাম লেখা রয়েছে। সম্প্রতি তোলা ছবি। প্রথম আলো

উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) খেলার মাঠটি দীর্ঘদিন ধরে দখল করে রেখেছে উত্তরা ফ্রেন্ডস ক্লাব। ক্লাবের সদস্য ছাড়া মাঠে এখন সেক্টরের কোনো বাসিন্দা খেলাধুলার সুযোগ পায় না বা অন্যান্য কাজে ব্যবহার করতে পারে না। সেক্টরের বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, তাঁরা শুধু সকাল-বিকেল নিয়ম করে ওয়াকওয়েতে হাঁটার সুযোগ পান। এ ছাড়া ক্লাবের পরিকল্পনা মাফিক মাঠ সব সময়ই ব্যস্ত থাকে।

অভিযোগ রয়েছে, উত্তরা ফ্রেন্ডস ক্লাব ফুটবল, ক্রিকেট ও রোলার স্কেটিং একাডেমি খুলে শিক্ষার্থী ভর্তি, মাঠে তাদের অনুশীলন ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এ ছাড়া ক্লাব কর্তৃপক্ষই বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে মাঠটি বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দেওয়াসহ সারা বছর স্পনসর এনে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করে। সেক্টর কল্যাণ সমিতি জানায়, এসব নিয়ে প্রতিবাদ করলে ক্লাব কর্তৃপক্ষ তাদের কথায় কান দেয় না। মাঠ এখন ক্লাবের নিয়ন্ত্রণে। আর এর সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের একাধিক প্রভাশালী জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ।

গতকাল বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, বিশাল আয়তনের ওই মাঠের চারদিক লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা। ভেতর ও বাইরের অংশে অসংখ্য পোস্টার, তাতে লেখা: ‘যত্রতত্র পোস্টার লাগানো থেকে বিরত থাকুন’ আর নিচে উত্তরা ফ্রেন্ডস ক্লাবের নাম। ক্লাবের মূল ফটকটি দক্ষিণ দিকে। এই ফটক দিয়েও মাঠে ঢোকা যায়। এ ছাড়া দক্ষিণ দিকেই মাঠে প্রবেশের আরেকটি ফটক আছে।

মাঠের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, দক্ষিণ-পশ্চিমে থাকা ক্লাব ভবনের পাশে একটি বাবুর্চিখানা। মাঠের হাঁটার রাস্তা পাশেই এর অবস্থান। সেখান থেকে আসছে মসলা আর রান্নার গন্ধ। হাঁটার রাস্তায় বস্তায় করে রান্নার উপকরণ রেখে দেওয়া হয়েছে। মাঠ থেকে সরাসরি বাবুর্চিখানায় যেতেও দরজা তৈরি করা হয়েছে।

অন্যদিকে রোলার স্কেটিং গ্রাউন্ডের পাশেই বাঁশ-ত্রিপল টানানো বসার জায়গা। সঙ্গে কবুতর পালনের ঘর। তার পাশে রয়েছে মোটরসাইকেল রাখার গ্যারেজ। মাঠের ভেতর ও বাইরে এই স্থাপনাগুলো ক্লাব কর্তৃপক্ষই পরিচালনা করে বলে জানিয়েছেন সেক্টরের বাসিন্দারা।

রাজউক সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে প্রথম রাজউক কর্তৃপক্ষ মাঠ দেখাশোনা ও রক্ষণাবেক্ষণের ভার ৩ নম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতির হাতে দেয়। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা উল্লেখ করে দুই পক্ষের তৎকালীন সভাপতির সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পাঁচ বছর পর ২০১২ সালে ওই চুক্তির নবায়ন করে আবারও কল্যাণ সমিতিকেই দায়িত্ব দেয় রাজউক। ২০১৭ সালে নবায়নকৃত পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হলে আবারও মাঠ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পেতে রাজউকের চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেন কল্যাণ সমিতির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। বিষয়টি বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন বলে জানা গেছে।

তবে সমিতির নেতারা বলেন, সেক্টরবাসীর সুবিধায় কাগজে-কলমে ৩ নম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতি দায়িত্ব পেলেও মাঠের প্রকৃত কর্তৃত্ব ক্লাবের হাতে। মাঠকে কেন্দ্র করে নানা কার্যক্রমও পরিচালনা করে উত্তরা ফ্রেন্ডস ক্লাব। তাঁরা আরও বলেন, ক্লাব কর্মকর্তাদের বাধার মুখে সেক্টরবাসীর প্রয়োজন সত্ত্বেও মাঠে কোনো উন্নয়নকাজই করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি মাঠের হাঁটার রাস্তা সম্প্রসারণ ও সংস্কারের প্রয়োজন হলেও ক্লাব সেটা করতে দিচ্ছে না।

উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতির সভাপতি এফ আর চৌধুরী বলেন, উত্তরা ফ্রেন্ডস ক্লাব দীর্ঘদিন ধরে এই মাঠের সুবিধা নিচ্ছে। তারা বাণিজ্যিকভাবে মাঠটি ব্যবহার করছে। সেক্টরবাসী মাঠে কিছু করতে গেলে সেটা ক্লাবের কর্মকর্তাদের অনুমতি নিতে হচ্ছে। কিন্তু এই মাঠ হলো সেক্টরবাসীর। সেটা সেক্টরবাসীর সম্মতিতে যেকোনো প্রয়োজনে ব্যবহার করা হবে। কিন্তু ক্লাবের কারণে এটা সম্ভব হচ্ছে না। অর্থাৎ নিজের মাঠ নিজের মতো ব্যবহার করতে পারছে না তারা। তিনি আরও বলেন, যেহেতু রাজউকের কাছে মাঠের রক্ষণাবেক্ষণের শেষ আবেদনটি এখনো প্রক্রিয়াধীন, তাই অনুমোদন পাওয়ার পরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আপাতত রাজউক এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে।

জানা যায়, ফ্রেন্ডস ক্লাবের ফুটবল, ক্রিকেট ও রোলার স্কেটিং একাডেমির সব মিলিয়ে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আছে। ভর্তির জন্য প্রতিজনের কাছ থেকে তিন হাজার টাকা করে নেওয়া হয়। আর প্রতি মাসে বেতন ১ হাজার ৫০০ টাকা।

অভিযোগ রয়েছে, ফ্রেন্ডস ক্লাব উত্তরার বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে মাঠটি ভাড়া দেয়। এক দিনের জন্য সর্বনিম্ন ভাড়া ৩০ হাজার টাকা। প্রতিষ্ঠানভেদে এই ভাড়ার পরিমাণ আরও বাড়ে বলেও জানা গেছে। একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠ ভাড়া নেওয়ার টাকার রসিদ দেখে বিষয়টি জানা গেছে।

উত্তরা ফ্রেন্ডস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সাহিদ আহম্মেদ সিদ্দিকী দাবি করেন, ‘ক্লাব ভবনের জায়গাটি রাজউক আমাদের বরাদ্দ দিয়েছে। তবে মাঠের জন্য যে আলাদা অনুমোদন নিতে হবে, সেটা আমাদের জানা ছিল না। কোনো দিন এসব বিষয়ে চিন্তাও করা হয়নি। কারণ, ১৯৮৬ সালে ক্লাব প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ৩৪ বছর ধরে এই মাঠ ক্লাবের নামেই ব্যবহার করে আসছি।’

বাণিজ্যিকভাবে মাঠ ভাড়া দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ক্লাব সম্পাদক বলেন, ‘আমরা কোনো প্রতিষ্ঠানকে মাঠ ভাড়া দিইনি। কেউ যখন মাঠ ব্যবহারের জন্য অনুমতি নিতে আসে, তখন তাদের সহযোগিতা করা হয়। এর বাইরে মাঠ সবার জন্যই উন্মুক্ত।’ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মাঠের যাবতীয়
পরিচর্চা ক্লাব কর্তৃপক্ষই করে আসছে বলে তিনি জানান। তিনি আরও বলেন, মাঠ ব্যবহার করতে কাউকে কখনো বাধা দেওয়া হয়নি। ৩ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা ও আশপাশের সব-সেক্টরের বাসিন্দারাই মাঠটি ব্যবহার করতে পারে।

ওয়াকওয়ে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে একমত জানিয়ে ক্লবের সম্পাদক বলেন, সময়ের তুলনায় এখন প্রচুর মানুষ হাঁটতে আসে। পাশ কাটাতে গিয়ে অনেক বয়স্ক লোক বাইরে পড়ে যান। তাই হাঁটার রাস্তা সংস্কার করা প্রয়োজন। কিন্তু এমন কাজে কল্যাণ সমিতিকে বাধা দেওয়া হয়নি। প্রয়োজনে মাঠটি সংরক্ষণের দায়িত্ব পেতে তাঁরা রাজউক বরাবর আবেদন করবেন বলে জানান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ফ্রেন্ডস ক্লাবকে কোনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি। তারা অবৈধ দখল করে আছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য কখনো কোনো প্রতিষ্ঠানকে মাঠের অনুমোদন দেওয়া হয় না। ফ্রেন্ডস ক্লাব বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করে থাকলে তাদের মাঠে রাখার প্রশ্নই আসে না।