পেট্রোবাংলার তদন্তেও তিতাসে দুর্নীতির চিত্র

>
  • গাজীপুর অঞ্চলে শতাধিক কোম্পানির ৬০০% পর্যন্ত অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহার
  • তিতাসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই এই দুর্নীতি
  • গ্যাস কারচুপির কারণে এক কোম্পানির কাছে তিতাসের পাওনা ৭৫ কোটি টাকা
  • টাকা আদায়ের কোনো উদ্যোগ নেই

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) তদন্তেও তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের শীর্ষ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। পেট্রোবাংলা তদন্ত করে অবৈধ গ্যাস ব্যবহারকারী চিহ্নিত করেছে, যার সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে তিতাসের কর্মকর্তাদেরও।

পেট্রোবাংলার কাছে অভিযোগ ছিল, গাজীপুর অঞ্চলে শতাধিক কোম্পানি ২০০ থেকে ৬০০ শতাংশ পর্যন্ত অনুমোদনের অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহার করে এবং এ কাজে তিতাসেরই কর্মকর্তারা জড়িত। পেট্রোবাংলা পরে অনুমোদনের অতিরিক্ত ১২০ শতাংশের বেশি গ্যাস ব্যবহারকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্যাস ব্যবহারের ওপর তদন্ত করতে ২০১৭ সালের ১১ অক্টোবর সংস্থার এক পরিচালককে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে।

তবে তদন্তের জন্য কমিটি শুধু ফার সিরামিক নামক একটি কোম্পানিকে বেছে নেয়। কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১২ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্যাস কারচুপির কারণে ফার সিরামিকের কাছে তিতাসের পাওনা দাঁড়িয়েছে ৭৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ফার সিরামিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তিতাসের চলতি দায়িত্বের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মীর মশিউর রহমানের কাছে কোম্পানিটির পরিদর্শন বিভাগ নথি উপস্থাপন করেছে। তা সত্ত্বেও ফার সিরামিক থেকে টাকা আদায়ে কোনো পদক্ষেপ নেননি তিনি।

পরে প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণ বিবেচনায় নিয়ে পেট্রোবাংলা গত ৭ জুন তিতাসের এমডিকে চিঠি দিয়ে আবার এই টাকা আদায়ের নির্দেশ দেয়। তবে তিতাসের এমডি ফার সিরামিকের কাছ থেকে অর্থ উদ্ধারে কোনো পদক্ষেপ নেননি।

এ বিষয়ে তিতাসের এমডি মীর মশিউর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি এবং পেট্রোবাংলার কাছে নির্দেশনা চেয়েছি।’ পেট্রোবাংলা তো চিঠি দিয়ে জানিয়েই দিয়েছে, নতুন কী নির্দেশনা চেয়েছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে এমডি বলেন, ‘চাওয়ার কারণ হচ্ছে, ফারকে আমরা চিঠি দিতে পারি না।’

ফার সিরামিক তিতাসের যে অঞ্চলের গ্যাস ব্যবহারকারী, কোম্পানিটির পাইপলাইন ডিজাইন বিভাগের একটি শাখার ব্যবস্থাপক সাব্বের আহমেদ চৌধুরী সেই গাজীপুরের ব্যবস্থাপক ছিলেন ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সময়েই ফার সিরামিক অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহার করেছে ১৪ কোটি টাকার।

ফার সিরামিকের পরিচালক ইরফান উদ্দিন গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পেট্রোবাংলার হিসাবে ভুল আছে। আর তিতাস থেকে আমরা কোনো চিঠি পাইনি বলে এখন কিছু বলতে পারছি না।’

তবে ফার সিরামিককে গ্যাস-সংযোগ দেওয়া ও বিচ্ছিন্ন করা এবং কোম্পানিটির মাধ্যমে গ্যাসের অবৈধ লোড ব্যবহার করার চিত্র উঠে এসেছে সরকারেরই একটি নজরদারি সংস্থার তথ্যে। দেখা যায়, সাব্বের আহমেদ চৌধুরী তিতাসের এমডিকে ২০১৬ সালের ৩১ আগস্ট এক খুদে বার্তায় জানান, ফার সিরামিকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। কারণ, কোম্পানিটি অতিরিক্ত লোড ব্যবহার করছে।

তবে তিতাস সূত্রে জানা গেছে, লাইন বিচ্ছিন্ন করার বিষয়ে তিতাসের গ্রাহক ফাইলে কোনো তথ্য নেই। তথ্য না থাকা ঘুষ খাওয়ারই একধরনের কৌশল বলে মনে করা হয়।

তথ্যে আরও দেখা যায়, ২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বর বেলা ১টা ২৩ মিনিটে এক খুদে বার্তায় সাব্বের তিতাসের এমডিকে জানান, ফার সিরামিকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে দল পাঠানো হয়েছে। তিতাস সূত্রে জানা গেছে, ওই দিন ঠিকই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। কিন্তু তিন দিনের মাথায় ফারকে পুনঃসংযোগ দেয় তিতাস।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিতাস গ্যাসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ঘুষ-দুর্নীতির কৌশলের কথা সবারই জানা। এখানে একটি ভয়ংকর চক্র রয়েছে। আশ্চর্যজনক যে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এ ব্যাপারে বরাবরই নিশ্চুপ।’