নিউইয়র্ক থেকে 'কোম্পানি' চালাচ্ছেন মেহেদী

>

• শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সহযোগী ছিলেন মেহেদী
• কমপক্ষে ৯টি খুনের ঘটনায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ
• মেহেদী এক যুগের বেশি সময় নিউইয়র্কে আছেন
• নিউইয়র্ক থেকে ঢাকার ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’ নিয়ন্ত্রণ করছেন
• গুলশান-বনানী-বাড্ডা এলাকায় মেহেদীর কিছু লোক আছেন
• তাঁরা দলকে বলেন কোম্পানি
• গত ১০ বছরে ওই এলাকায় ১৪টি খুন হয়েছে
• খুনের পেছনে ছিল হয় মেহেদী, নয়তো রবিন কোম্পানি গ্রুপ

ভদ্রলোকের চোখ সিসিটিভিতে। কক্ষের দরজা ভেজানো। তবু কথা বলছেন সতর্কতার সঙ্গে। জানালেন, আগামী মাস থেকে ফটকে নিরাপত্তারক্ষী বসাচ্ছেন, পাঁচিল উঁচু করা হয়েছে, তার ওপর কাঁটাতারের বেড়া। মেহেদী যাঁকে ধরেন, তাঁকে ছাড়েন না।

ভুক্তভোগী ব্যক্তি নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করতে চাননি। তাঁর সঙ্গে মেহেদীর বিরোধ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনে সদস্যদের নাম প্রস্তাব করা নিয়ে। তাঁর যুক্তি হলো, মেহেদী এক যুগের বেশি সময় নিউইয়র্কে আছেন। সেখান থেকে তিনি ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’ নিয়ন্ত্রণ করছেন। তিনি সেটা নিয়েই থাকুন। রাজনীতিতে কেন? এ নিয়ে কথা-কাটাকাটির জেরে মেহেদী তাঁকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন।

এই ব্যক্তি তবু সতর্কতার সঙ্গে স্বাভাবিক জীবনযাপন করার চেষ্টা করছেন। একরকম প্রাণের ভয়ে লুকিয়ে আছেন বাড্ডার কেবল টিভি নেটওয়ার্কের ব্যবসা করেন—এমন এক ব্যক্তি। গত মে মাসে তাঁর সহযোগী আবদুর রাজ্জাক খুন হয়েছেন। তাঁকে উদ্ধৃত করে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মেহেদী ফোন করে ব্যবসা-বাণিজ্য তাঁর লোকজন ভাগনে মানিক ও পুলককে বুঝিয়ে দিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন। কথা না শুনলে কী হতে পারে, তা–ও বুঝিয়ে দিয়েছেন।

একটা সময় রাজধানীর গোপন জগৎ বা ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’ নিয়ন্ত্রণ করত শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪২ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম প্রকাশ করেন। ২০০৬-০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ধারাবাহিক অভিযানে তাঁদের অনেকে নিহত হন, আবার অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ ও স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সহযোগী হিসেবে যাঁরা একসময় সক্রিয় ছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ এখন আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করছেন। গুলশান-বনানী-বাড্ডা এলাকার মেহেদী হাসান তাঁদের একজন। একসময় শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সহযোগী ছিলেন তিনি। এখন নিউইয়র্ক থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন সবকিছু।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, ২০০০ সালের দিকে সায়েম ও শহীদুলকে খুন করে মেহেদী দেশ ছেড়ে চলে যান। এরপরও ২০০৯ সালে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নাজিম, ২০১৫ সালে আদর্শনগর পানির পাম্পের একটি কক্ষে বাড্ডার ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শামসুদ্দিন মোল্লা, ব্যবসায়ী ফিরোজ আহমেদ, ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান এবং যুবলীগ নেতা আবদুস সালাম, ২০১৮ সালে কামরুজ্জামান দুখু ও ফরহাদ আলী খুনের ঘটনায় তাঁর সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে। তবে শেষ দুটি হত্যাকাণ্ডের আগে তদন্তে পুলিশের তেমন তোড়জোড় ছিল না।

মেহেদী হাসান কীভাবে নিউইয়র্কে থেকে আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলছিলেন, এলাকায় মেহেদী হাসানের কিছু লোক আছেন। তাঁরা এই দলকে বলেন কোম্পানি। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে কোনো না কোনো পক্ষ মেহেদীর সঙ্গে যোগাযোগ করে। মেহেদীর কোম্পানি টাকার বিনিময়ে লোকজন জড়ো করে একটি পক্ষকে বসিয়ে দেয়। কখনো কোম্পানির লোকজন ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকেন, কখনো শুধু আড়ালে থেকে পরিচালনা করেন।

স্থানীয় বাসিন্দা, গুলশান-বাড্ডা এলাকার রাজনৈতিক নেতারা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১০ বছরে ওই এলাকায় ১৪টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এই খুনগুলোর পেছনে ছিল হয় মেহেদী, নয়তো রবিন কোম্পানি গ্রুপ। ডিবি পুলিশের ধারাবাহিক অভিযানে রবিন কোম্পানি গ্রুপ এখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। ফলে পুরো এলাকার দখল চলে গেছে মেহেদীর হাতে।

ক্ষমতার উৎস কী
বাড্ডা থানায় মেহেদী হাসানের নামে ফাইল খোলা হয়েছে সদ্যই; নাম মেহেদী হাসান ওরফে কলিন্স। বাবা আলী ইমাম। মা নারগিস রহমান। তিন ভাই। পড়তেন তিতুমীর কলেজে। এখন নিউইয়র্কে থাকেন। ঢাকায় তাঁর সহযোগী উত্তর বাড্ডার আরিফ, গোপীপাড়ার রমজান ও সাগর, পোস্ট অফিস গলির পুলক, সবজি গলির মান্নান, ছাত্রলীগের ইনসান ও যুবলীগের মহারাজ। অপরাধের বিবরণ শূন্য।

বাড্ডা থানার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল একটি সূত্র প্রথম আলোকে বলেছে, মেহেদী হাসানের নামে কেউ অভিযোগ দেন না। সে কারণে তাঁর নামও সেভাবে খাতায় নেই। কামরুজ্জামান দুখু ও ফরহাদ খুনের পর তাঁর সম্পৃক্ততার বিষয়টি উঠে আসে।

তবে স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, মেহেদী হাসান সব সময় প্রশাসনের সহযোগিতা পেয়ে এসেছেন। বাড্ডার ‘ফোর মার্ডার’ তদন্তে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

২০১৫ সালের ১৩ আগস্ট রাতে বাড্ডার আদর্শনগর পানির পাম্পের একটি কক্ষে ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান ওরফে গামাসহ চারজন খুন হন। মাহবুবুরের বাবা মতিউর রহমান ওই ঘটনায় ১০-১২ জনকে আসামি করে বাড্ডা থানায় মামলা করেন।

প্রায় এক বছর পর ডিবি ওই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করে। মাহবুবুরের বাবা নারাজি দিলে মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে স্থানান্তর করা হয়। তাঁর অভিযোগ ছিল, মাহবুবুর খুন হয়েছিলেন গরুর হাটের ইজারা নিয়ে বিরোধের জেরে। বিরোধ ছিল ভাগনে ফারুক ও মেহেদীর লোকজনের সঙ্গে। ডিবি অভিযোগপত্রে সে বিষয়টিই উল্লেখ করেনি।

ওয়াকিবহাল সূত্রগুলো বলছে, মেহেদী হাসান তাঁর লোকজনের সারা বছরের খরচ ওঠান গরুর হাট থেকে। মাহবুবুর গামা প্রায় ৫ কোটি টাকা দিয়ে গরুর হাটের ইজারা পেয়েছিলেন। ভাগনে ফারুক ও মেহেদী ওই হাট থেকে ৬০ লাখ টাকা দাবি করলেও টাকা দিতে রাজি হননি। এরপর থেকেই মেহেদী তাঁকে খুনের হুমকি দিচ্ছিলেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেহেদী একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট। ১৯৯৩-৯৮ সময়কাল পর্যন্ত মেহেদী তিতুমীর কলেজে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সায়েম-শহীদুল খুন হওয়ার পর তিনি সস্ত্রীক দেশ ছাড়েন। নিউইয়র্কে আগে থেকেই থাকতেন মেহেদীর বাবা জাতীয় পার্টির একসময়ের কেন্দ্রীয় নেতা আলী ইমাম। ঢাকায় মেহেদী ছিলেন তাঁর মামার কাছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৪-১৫ বছর ধরে বাংলাদেশে না থাকলেও বনানী থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক তিনি। এই কমিটির সাধারণ সম্পাদক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের এপিএস (রাজনৈতিক) মোশাররফ হোসেন বলেন, মেহেদী একজন ত্যাগী ছাত্রনেতা ছিলেন। দেশে যাওয়া–আসার মধ্যে থাকেন। তবে তাঁর নামে কোনো অভিযোগের কথা তিনি জানেন না। যদি সত্যি মেহেদী কোনো অন্যায় করে থাকেন, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থা নিতে পারে। তিনি এতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবেন।

ডিবির (উত্তর) উপকমিশনার মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা গুলশান-বাড্ডা এলাকার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন। গেল কয়েক মাসে তাঁরা প্রায় ৪০ জনকে গ্রেপ্তার করেছেন। মেহেদীর সহযোগী অমিতসহ নিহত হয়েছেন চারজন। তাঁদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।