পরিকল্পনার গলদে বেহাল সড়ক

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে খানাখন্দ। এতে কাদা, পানি জমে চলাচলে বিঘ্ন হয়। তৈরি হয় যানজট। গত শনিবার টঙ্গী বাজার এলাকায়।  ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে খানাখন্দ। এতে কাদা, পানি জমে চলাচলে বিঘ্ন হয়। তৈরি হয় যানজট। গত শনিবার টঙ্গী বাজার এলাকায়। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
>

• ব্যয় প্রচুর, অথচ টিকছে না সড়ক
• ৪,৭৫০ কিমি সড়ক বেহাল
• ৯ বছরে রক্ষণাবেক্ষণে খরচ ১১ হাজার কোটি টাকা
• নতুন প্রকল্পে ৪৬,৫০০ কোটি টাকা

সড়ক ও মহাসড়ক নির্মাণের পরিকল্পনায় গলদ আছে। সড়কের স্থায়িত্ব কম। নেওয়া হয় প্রচুর রাজনৈতিক প্রকল্প। প্রকল্পে সড়ক নির্মাণে বরাদ্দ থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণে আলাদা বরাদ্দ থাকে না। আবার যথাসময়ে প্রকল্পও শেষ করা যায় না। সার্বিকভাবে সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে তুলনামূলক বেশি খরচ হয়, সময় বেশি লাগে।

আবার মহাসড়কে দ্রুতগতি ও ধীরগতির যানবাহন একই সঙ্গে চলাচল করে। এ ছাড়া মোড়গুলোতে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়। শুধু ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়, ইন্টারসেকশন তৈরি করা হয় না। এতে ফ্লাইওভারগুলোর ওঠানামার পথে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। পণ্যবাহী ট্রাকে অতিরিক্ত ওজনের মালামাল নেওয়ার কারণে সড়ক নষ্ট হয়ে যায়।

গতকাল রোববার সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা এভাবেই সড়কের দুরবস্থার কথা তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নিজেই সড়কের দুরবস্থা নিয়ে সওজ কর্মকর্তাদের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের কর্মকর্তাদের অনেকেই আত্মসমালোচনা করেন। এই খাতের বিশেষজ্ঞরা সড়ক পরিকল্পনার দুর্বলতাগুলো তুলে ধরেন।

শেরেবাংলা নগরের পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলনকক্ষে ‘বাংলাদেশে মানসম্পন্ন সড়ক অবকাঠামো বিনির্মাণ: সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম। সরকারি কর্মকর্তা ও বেসরকারি খাতের বিশেষজ্ঞরা সেমিনারে অংশ নেন। 

বেহাল সড়ক পৌনে পাঁচ হাজার কিলোমিটার

সওজের গত মে মাসের হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশের বেহাল সড়ক ৪ হাজার ৭৩১ কিলোমিটার, যা মোট সড়ক ও মহাসড়কের চার ভাগের এক ভাগের বেশি। বর্তমানে সওজের অধীনে ২১ হাজার কিলোমিটারের বেশি সড়ক আছে।

সওজের সড়কগুলোর মেরামত রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন খাতে খরচ গত ৯ বছরে (২০০৯ সালের জুন থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত) ১১ হাজার ৯৪ কোটি টাকা। উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন সড়ক ও মহাসড়ক নির্মাণ ও উন্নয়নে খরচ হয়েছে আরও ৪৬ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে খরচ ৫৭ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে দুটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত।

চলতি অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) সওজের অধীনে ১২৭টি প্রকল্প চলমান আছে। এসব প্রকল্পে এ বছর ১৫ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা খরচ করা হবে। উল্লেখ্য, ২০১০ সাল থেকেই শুধু সাংসদদের পছন্দমতো তাঁদের এলাকায় রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে। এ জন্য তাঁরা প্রত্যেকে প্রতিবছর ৩ থেকে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ পাচ্ছেন। এ ছাড়া গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের নামে প্রায় প্রতিটি জেলায় স্থানীয় পর্যায়ে সড়ক নির্মাণ করার একাধিক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এ রকম এক পরিস্থিতিতে সড়কের বেহাল ব্যবস্থাপনা নিয়ে সেমিনার করল সরকারি সংস্থাটি।

গতকালের সেমিনারের প্রধান অতিথি পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘ঢাকা থেকে বের হলে আপনি বুঝবেন না, আপনি চট্টগ্রাম যাচ্ছেন, নাকি সিলেট যাচ্ছেন নাকি আবার ঢাকা ফিরে আসছেন। সড়কে এ–সংক্রান্ত কোনো সিগন্যাল বা নির্দেশক নেই।’ তিনি আরও বলেন, যানজট এড়াতে ছোট–বড় শহরে বাইপাস সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এর ফলে দু–এক বছরের মধ্যে সেই বাইপাসের আশপাশে দোকানপাট হয়ে যায়। এতে আবার যানজট হয়। এভাবে বাইপাস হলে সারা দেশ একসময় বাইবাস সড়কে ভরপুর হয়ে যাবে। পরিকল্পনামন্ত্রী আক্ষেপ করে বলেন, এভাবে সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ করা হলে ২০৪১ সালের লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না। 

সড়কে সমস্যা

সড়ক, যানজট নিয়ে সেমিনারে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন। তিনি বলেন, ‘মালিবাগ-মগবাজার ফ্লাইওভার দিয়ে সাঁই সাঁই করে চলে আসলাম। কিন্তু বাংলামোটরে নামার পথে ৪১ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলাম। এটা আসলে পরিকল্পনার দুর্বলতা। মোড়গুলোতে কীভাবে গাড়ি চলবে, তা ঠিক করতে পারছি না।’ তিনি বলেন, ‘রাস্তায় যানজটে গাড়ি যখন দাঁড়িয়ে থাকে, তখন মনে হয়, ডলার ছিঁড়ছি। প্রতি মুহূর্তে তেল পুড়ছে। কষ্টার্জিত এই বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে আমরা জ্বালানি আমদানি করছি, তা যানজটে পুড়ছে। এভাবে যত ডলার পুড়ছে, এর চেয়ে কম পয়সায় মানসম্পন্ন মসৃণ চলাচল নিশ্চিত করতে পারতাম।’

মোবাশ্বের হোসেনের মতে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই এত ফ্লাইওভার বানানো হচ্ছে। সড়কও বানানো হচ্ছে।

সড়ক ও মহাসড়কে মোড় ব্যবস্থাপনা একটি বড় সমস্যা বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক। তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু ফ্লাইওভার নির্মাণ করছি। ইন্টারসেকশন নির্মাণ করছি না। কেবল কুড়িল ইন্টারসেকশনটি একটি ভালো উদাহরণ। এমন সড়ক নির্মাণ করতে হবে যেন চট্টগ্রাম থেকে চার লেনের মহাসড়ক পাড়ি দিয়ে রাজধানীর উপকণ্ঠে সানারপাড়ে এসে গাড়ি থেমে যাবে না।’ তাঁর মতে, ‘আমরা সড়ক নির্মাণের সময় মোড়গুলোতে পর্যাপ্ত জায়গা রাখছি না। এর ফলে যানজটের সৃষ্টি হয়। রাস্তায় যানবাহন প্রবেশের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। মহাসড়কেই যখন-তখন নছিমন–করিমন ঢুকে পড়ছে।’

পরিকল্পনাসচিব জিয়াউল ইসলাম ও একই মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব মফিজুল ইসলাম মহাসড়কে নিজেদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। পরিকল্পনাসচিব বলেন, ‘কয়েক দিন আগেই এক জেলায় গেলাম। সেই জেলায় যাওয়ার সময় আমার গাড়ির চালক বললেন, এই সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে বরাদ্দের ছয় ভাগের এক ভাগ টাকাও খরচ করা হয়নি। এই সড়ক ছয় মাসও টিকবে না।’

লেখক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, যতই টাকা খরচ করা হোক না কেন, রাজনৈতিক অঙ্গীকার যদি ঠিক না থাকে, তবে জনগণের কোনো উপকার হবে না।

হাইওয়ে পুলিশের উপপুলিশ মহাপরিদর্শক আতিকুল ইসলাম জানান, অতিরিক্ত ওজনের পণ্যবাহী ট্রাক চলাচলের কারণে সড়ক টিকে না।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ অভিযোগ করেন, ‘একই ঠিকাদার অনেক বেশি কাজ পেয়ে যাচ্ছেন। এতে দু–একজন ঠিকাদারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছি।’ 

আত্মসমালোচনা

বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের সমালোচনার পর অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম আত্মসমালোচনা করেন। তিনি বলেন, অনেকেই সড়কের মান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে এটা ঠিক। রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির কারণে অনেক সময় জরুরি ভিত্তিতে রাস্তা নির্মাণ করতে হয়। কিছু সড়কের কাজ সময় নিয়ে করা হয়। যেসব সড়ক সময় নিয়ে করা হয়, সেগুলোর অবস্থা বেশ ভালো।

নজরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘সড়কের এমন কোনো প্রকল্প নেই যেখানে বিদেশ সফর নেই। প্রতিবছর বিদেশ সফরে গিয়ে আমরা কী শিখলাম?’

সওজ সূত্রগুলো বলছে, সওজের অধীন প্রকল্পের কিছু প্রবণতা দেখা যায়। এগুলো হচ্ছে উন্নয়ন প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়িত হয় না। এতে খরচ বাড়ে। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার মতো অগ্রাধিকার প্রকল্পেও এটা দেখা গেছে। অন্যদিকে মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণের কাজ হয় ঈদ, বর্ষা ও অর্থবছরের শেষের দিকে। তাড়াহুড়ো করে জোড়াতালি দিয়ে চলে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ। কিছুদিন পরই আবারও আগের দশা হয়। সড়ক-মহাসড়কে দুরবস্থা দূর করা এবং মানুষের ভোগান্তি কমানোর জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সওজের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে সারা দেশে মোট ২৩টি পর্যবেক্ষণ (মনিটরিং) দল আছে। এই দলের সদস্যরা পরিদর্শন করে তাৎক্ষণিকভাবে সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। অভিযোগ আছে, এই দলের সদস্যদের পরিদর্শন কার্যক্রম অনেকটা ‘পিকনিক’–এ পরিণত হয়েছে। 

মূল প্রবন্ধ

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ সড়ক গবেষণাগারের পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন। মূল প্রবন্ধে বলা হয়, এই মুহূর্তে জরুরি ভিত্তিতে চারটি বিষয় প্রয়োজন। এগুলো হলো রক্ষণাবেক্ষণকে অগ্রাধিকার; প্রাতিষ্ঠানিক সম্প্রসারণ; দেশজ উদ্ভাবনে গবেষণা ও উন্নয়নকে প্রাধান্য দেওয়া এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রশিক্ষণ। সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণ ছয়টি। এগুলো হলো নির্মাণসামগ্রীর নিম্নমান; দুর্বল পয়োনিষ্কাশন; নকশায় অপর্যাপ্ততা; মান নজরদারিতে দুর্বলতা, কাঁচামাল প্রাপ্তিতে সমস্যা এবং অতিরিক্ত ওজন।

মূল প্রবন্ধে আরও বলা হয়, উন্নত রাষ্ট্রে উন্নীত হতে হলে ৮০ হাজার কিলোমিটার সড়ক লাগবে। ৪ হাজার কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করতে হবে। এ জন্য বেসরকারি খাতের অংশ প্রয়োজন।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসান।