অচিরেই ঢাকা-নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালু হবে: প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্ক সিটির ম্যানহাটন হিলটন হোটেলের গ্র্যান্ড বলরুমে ‘প্রবাসী নাগরিক সংবর্ধনা’ সমাবেশে বক্তব্য দেন। ছবি: পিআইডি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্ক সিটির ম্যানহাটন হিলটন হোটেলের গ্র্যান্ড বলরুমে ‘প্রবাসী নাগরিক সংবর্ধনা’ সমাবেশে বক্তব্য দেন। ছবি: পিআইডি

নিউইয়র্কে নাগরিক সংবর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর ও হত্যাচেষ্টাকারীরা একজোট হয়ে তথাকথিত জাতীয় ঐক্য গড়ে সরকারের পতন ঘটাতে চায়। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তার জন্য। এই আইনের জন্য সাংবাদিকদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। সাংবাদিকেরা শুধু সাংবাদিকদের স্বার্থ দেখলে হবে না। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বিমানের নতুন সংযোজন ড্রিমলাইনার দিয়ে অচিরেই ঢাকা-নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালু করা হবে বলেও ঘোষণা দেন। 


শেখ হাসিনা ২৩ সেপ্টেম্বর রোববার স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় নিউইয়র্ক সিটির ম্যানহাটন হিলটন হোটেলের গ্র্যান্ড বলরুমে ‘প্রবাসী নাগরিক সংবর্ধনা’ সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন। জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে বর্তমানে তিনি নিউইয়র্কে অবস্থান করছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুক্তফ্রন্টের নামে দুর্নীতিবাজেরা এক হয়েছে। তারা ক্ষমতায় এলে দেশের সম্পদ লুটে খাবে। আওয়ামী লীগ সততায় বিশ্বাস করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেখানো পথে বাংলাদেশ পরিচালিত হওয়ায় এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও খ্যাতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়ন আর শান্তির রোল মডেল। মানবিকতার প্রশ্নেও সারা বিশ্ব প্রশংসার সঙ্গে বাংলাদেশের নাম উচ্চারণ করছে। এসব অর্জনে প্রবাসীদের অকুণ্ঠ সমর্থনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা করতে চাই।’

যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ এই সংবর্ধনার আয়োজন করে। সংগঠনের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানের সভাপতিত্বে এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আবদুস সামাদ আজাদের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম মাহমুদ আলী, আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী আবদুস সোবহান গোলাপ।

সংবর্ধনায় নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, পেনসিলভানিয়া, কানেকটিকাট, বোস্টন, ওয়াশিংটন মেট্রো, ভার্জিনিয়া, ফ্লোরিডা, জর্জিয়া, মিশিগান, লস অ্যাঞ্জেলেস, শিকাগোসহ বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে নেতা-কর্মীরা যোগ দেন। সমাবেশে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ, মহিলা লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীসহ বিপুলসংখ্যক প্রবাসী উপস্থিত ছিলেন। নেতা-কর্মীরা স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত রাখেন পুরো হল। বিভিন্ন স্লোগানের পাশাপাশি ‘নো মোর সিদ্দিক’ স্লোগানটি উচ্চারিত হয় বারবার।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন দলীয় নেতা-কর্মী ও প্রবাসী বাংলাদেশিরা। ছবি: প্রথম আলো
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন দলীয় নেতা-কর্মী ও প্রবাসী বাংলাদেশিরা। ছবি: প্রথম আলো

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাত প্রায় সাড়ে আটটায় সমাবেশস্থলে উপস্থিত হলে উৎফুল্ল নেতা-কর্মীরা মুহুর্মুহু স্লোগানে তাঁকে বরণ করে নেন। তিনি বক্তব্যের শুরুতেই স্মরণ করেন ১৫ আগস্ট নৃশংসভাবে নিহত বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা ও অন্য শহীদদের; জাতীয় চার নেতাকে ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত লোকজনকে। তিনি বলেন, ‘জাতির জনক তাঁর পুরো জীবন মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছেন। তিনি একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বিশ্বে বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সেই কাজ সমাপ্ত করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ দিয়ে গেছেন। তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। আমরা দুই বোন বাইরে ছিলাম বলে বেঁচে যাই। আর সবাইকে হারিয়েছিলাম। আমরা ছয় বছর দেশের বাইরে ছিলাম। ১৯৮১ সালে আমি বিদেশে থাকা অবস্থায় আমাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি করা হয়। আমি মানুষের ভালোবাসায় দেশে ফিরে আসি। স্বাধীনতাবিরোধীরা ক্ষমতায় এসেছিল। মন্ত্রী হয়েছিল।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্বাধীনতার সময়সহ সব সময় প্রবাসী বাংলাদেশিরা সহযোগিতা করে আসছে। আমাদের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রয়েছে প্রবাসীদের। ২০০৭ সালে আমাকে দেশে যেতে বাধা দেয় তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপ ও বাংলাদেশের মানুষের আন্দোলনের কারণে আমাকে দেশে যেতে দেওয়া হয়। তখন আপনারা প্রবাসীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমার সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। সে জন্য ধন্যবাদ।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা ২০০৯ সালে সরকার গঠন করি। এই কয়েক বছরে যে উন্নতি হয়েছে, তা স্মরণীয়। আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।’ তিনি বঙ্গবন্ধুর নীতির কথা স্মরণ করে বলেন, ‘আমাদের নীতি হচ্ছে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়। বিশ্বের সকল দেশের সঙ্গে সফল কূটনৈতিক সম্পর্ক সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও যুব সমাজের এন্টারপ্রেনার হিসেবে আত্মপ্রকাশ আজ বাংলাদেশকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।’ তিনি সরকারের নানামুখী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বিশ্বে আজ বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ ডিজিটাল হচ্ছে। আমরা কৃষকদের ভর্তুকি দিচ্ছি, ৮০ ভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ দিচ্ছি, মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন রান্না চলে বিদ্যুতে, রিকশা চলে ব্যাটারিতে। বাংলাদেশে খাদ্যের অভাব নেই, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, সবাই শান্তিতে আছে। এখন আমাদের সমস্যা হচ্ছে রোহিঙ্গা সমস্যা।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশের উন্নয়নে কেউ বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না। বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বার্থে আওয়ামী লীগকে আবারও ক্ষমতায় আনতে হবে। ২০২১ সালের মধ্যে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ যাবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এসব উন্নয়নের কথা বলে ভোট বাড়াতে হবে, ইমেজ বাড়াতে হবে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশের উন্নয়ন হয়। আর বিএনপি এলে দুর্নীতি হয়, স্বজনপ্রীতি হয়। খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেকের দুর্নীতির কথা আমেরিকায় প্রমাণ হয়েছে। তার শাস্তি হয়েছে। খালেদা জিয়া এতিমদের অর্থ মেরেছেন। যে কারণে তিনি জেলে রয়েছেন।’

আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই আলোকচিত্রী শহিদুল আলম শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উসকানি দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ইতিহাসের নির্মম ও বর্বর হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে দেশত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গা আসছে। আমরা মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিয়েছি। ১৬ কোটি মানুষকে যদি খাওয়াতে পারি, ৯ লাখ মানুষকে খাওয়াতে পারব না কেন? শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদান, খাদ্য, বস্ত্র ও চিকিৎসাসেবা দিচ্ছি, স্বেচ্ছাসেবক দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে হবে, নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির জন্যই আমি এখানে এসেছি।’ রোহিঙ্গা ইস্যুতে পাশে দাঁড়ানোয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মিয়ানমারকে অবশ্যই তাদের নাগরিকদের ফেরত নিতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ার লক্ষ্যে জাতির পিতার জীবন ও আদর্শকে ধারণ করে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আগামী জাতীয় নির্বাচনে পুনরায় আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করে বাংলাদেশের চলমান উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে বিভক্তি ভুলে সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘স্লোগান না দিয়ে দলের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড মানুষের কাছে তুলে ধরুন, দলের জন্য কাজ করুন যাতে দল আবার ক্ষমতায় আসতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘আগামী নির্বাচন হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে চাই। জাতির পিতার সোনার বাংলা গড়তে চাই। আগামী ২০২১-এ মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১-এ উন্নত দেশে পরিণত করতে চাই।’

এর আগে জাতিসংঘের ৭৩তম সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে লন্ডন থেকে নিউইয়র্কে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার সকালে বিশ্ব মাদক সমস্যা বিষয়ে বৈশ্বিক আহ্বানসংক্রান্ত একটি সভায় যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর। এতে উপস্থিত থাকবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও জাতিসংঘ মহাসচিব। বিকেলে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে নেলসন ম্যান্ডেলা পিস সামিটে ভাষণ দেবেন তিনি। একই দিনে শরণার্থীবিষয়ক বৈশ্বিক কমপ্যাক্ট ও শিক্ষাবিষয়ক দুটি ইভেন্টে অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া দুপুরে ইউএস চেম্বার অব কমার্স আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় তিনি অংশগ্রহণ করবেন। প্রধানমন্ত্রী কাল ২৫ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের নিরস্ত্রীকরণবিষয়ক কার্যালয়ের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত সাইবার সিকিউরিটি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতাবিষয়ক সভায় বক্তব্য দেবেন। জাতিসংঘ মহাসচিবের আয়োজনে অ্যাকশন ফর পিস কিপিং বিষয়ক সভায় অংশগ্রহণ করবেন। এতে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ক্রমাগত উন্নতির বিষয়গুলো তুলে ধরবেন।