শুরুতে স্বাগত, এখন ষড়যন্ত্রের সন্দেহ

>

• ঐক্য প্রক্রিয়া সরকারবিরোধী জোটে পরিণত হয়েছে
• ঐক্য সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনার জন্ম দিয়েছে
• আ. লীগ ও ১৪-দলীয় জোট কিছুটা হলেও ভাবনায় পড়েছে
• শুরুতেই ঐক্য প্রক্রিয়াকে চাপে ফেলতে চায় ক্ষমতাসীন জোট
• ঐক্য প্রক্রিয়ার কঠোর সমালোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী

শুরুতে স্বাগত জানালেও এখন ‘বৃহত্তর ঐক্য’ প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে একযোগে মাঠে নেমেছে সরকারি দল ও জোট। এখন তারা এই ঐক্যকে ‘ষড়যন্ত্রের অংশ’ বলে প্রচারে নেমেছে।

গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ঐক্য প্রক্রিয়ার কঠোর সমালোচনা করেন। নিউইয়র্কে নাগরিক সংবর্ধনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খুনি, অর্থ পাচারকারী ও সুদখোরেরা আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে একজোট হয়েছে। এরা দেশের সম্পদ লুটে খেয়েছে। এরা ক্ষমতায় গেলে স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে মিলে দেশ ধ্বংস করবে। ড. কামাল হোসেন ও বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সরকারবিরোধী জোটের কঠোর সমালোচনা করে তিনি প্রশ্ন করেন, দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে নিয়ে তাঁরা কীভাবে দুর্নীতি প্রতিরোধ করবেন?

এদিকে আওয়ামী লীগ ও ১৪–দলীয় জোটের একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ডান–বাম ও মধ্যপন্থী মতের সম্মিলন কিছুটা হলেও ভাবনায় ফেলেছে তাদের। কারণ, এই ঐক্য সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তাই শুরুতেই তাদের চাপে ফেলতে চায় ক্ষমতাসীন জোট।

ওই সূত্র জানায়, ১৪–দলীয় জোটের ধারণা ছিল, আদর্শিক মতপার্থক্য থাকায় এই জোট এক হতে পারবে না। কামাল হোসেন ও বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে বিএনপির নেতৃত্ব মানতে পারবেন না। ফলে ঐক্য প্রক্রিয়া মুখ থুবড়ে পড়বে। কিন্তু নির্বাচন সামনে রেখে একসুরে দাবিদাওয়া পেশ করার কারণে ঐক্য প্রক্রিয়া সরকারবিরোধী জোটে পরিণত হয়েছে।

অবশ্য ক্ষমতাসীন জোটের নীতিনির্ধারকেরা এখনো মনে করেন, চাপে রাখতে পারলেই এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় ফাটল ধরবে। তাই একযোগে সমালোচনায় নেমেছে ১৪ দল। এ জন্য কয়েকটি বিষয় সামনে নিয়ে আসতে চায় ক্ষমতাসীন জোট। এগুলো হচ্ছে ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেতাদের এক-এগারোর কুশীলব হিসেবে আখ্যা দেওয়া, সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ‘ষড়যন্ত্রে’ সহায়তাকারী, আগামী সংসদ নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টাকারী এবং দুর্নীতিবাজ ও যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার তৎপরতার অংশ।

নিউইয়র্ক সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের কঠোর সমালোচনার পাশাপাশি গতকাল সকালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের বৈঠকেও ঐক্য প্রক্রিয়ার সমালোচনা করা হয়। এই জোটকে ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। গতকাল কক্সবাজারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এই ঐক্য জগাখিচুড়ির ঐক্য। এটি বেশি দিন টিকবে না।

গতকাল ধানমন্ডির প্রিয়াঙ্কা কমিউনিটি সেন্টারে ১৪ দলের বৈঠকজুড়েই আলোচনা ছিল ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে। আজ মঙ্গলবার বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করবে ১৪ দল। ২৯ সেপ্টেম্বর মহানগর নাট্যমঞ্চে নাগরিক সমাবেশ এবং অক্টোবরের মধ্যে দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহরে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে ১৪ দল।

অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতারা প্রথমে ঐক্য প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। গত ৩০ মে ভারত সফর শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ঐক্য প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানান। এরপর নেপালে বিমসটেক সম্মেলন থেকে ফিরে ২ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলনেও প্রধানমন্ত্রী ঐক্য প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানান। সর্বশেষ ১৫ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির বৈঠকে আরেকবার স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি ওই দিন বলেন, আওয়ামী লীগবিরোধী একটা প্ল্যাটফর্ম থাকা দরকার। তিনি বিরোধীদের জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সভা-সমাবেশ করতে স্থায়ী মঞ্চ করে দেওয়ার কথাও বলেন। গত বছর ডিসেম্বরে বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও মাহমুদুর রহমান মান্নার যুক্তফ্রন্ট গঠনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছিলেন ওবায়দুল কাদের। আওয়ামী লীগের নেতারা ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে খুব একটা সমালোচনামুখর ছিলেন না। কিন্তু গত শনিবার মহানগর নাট্যমঞ্চে ঐক্য প্রক্রিয়ার ডাকে নাগরিক সমাবেশ হওয়ার পর সমালোচনা শুরু হয়। ওই সমাবেশে বিএনপিও যোগ দিয়েছিল।

এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার বুঝতে পারছে না যে দেশের মানুষ ভোটাধিকার ফিরে পেতে চায়। এ জন্য এক বাক্যে সবাই এখন ঐক্যবদ্ধ।’ তিনি বলেন, ‘ব্যাংক লুট, শেয়ারবাজার লুট, সরকারের লুটপাটের চিত্র প্রতিদিন গণমাধ্যমে আসছে। সে দুর্নীতি কারা করছেন? এখন যদি প্রধানমন্ত্রী অন্যদের গায়ে দুর্নীতিবাজের তকমা লাগানোর চেষ্টা করেন, সেটা তিনি করতে পারেন। কিন্তু মানুষ যা বোঝার বুঝে নিয়েছে।’ 

১৪ দলের বৈঠক

গতকালের ১৪ দলের বৈঠকসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শুরুতেই আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনার কথা বলেন। এরপর সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, কামাল হোসেন গংরা ডুবন্ত বিএনপি-জামায়াতের দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের ইজারা নিয়েছেন। তাঁরা ঐক্য প্রক্রিয়ার নামে নির্বাচন বানচালের চক্রান্তে মেতে উঠেছেন। তাঁরা শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার ষড়যন্ত্র নিয়ে মাঠে নেমেছেন।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ-ইনু) সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার বলেন, দেশকে ভালোর দিকে নেওয়ার কোনো উদ্দেশ্য তাঁদের মধ্যে নেই। এটি ষড়যন্ত্রের ঐক্য।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, কামাল হোসেনকে যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের সময় আদালত প্রাঙ্গণে এক দিনের জন্যও দেখা যায়নি। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময়ও নানা দ্বিচারিতা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার নিয়ে নীরবতা পালন করেছেন। এই দিকগুলো এখন জনগণের সামনে নিয়ে আসা উচিত।

জাসদের একাংশের সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া বলেন, কামাল হোসেনের নেতৃত্বে যে তৎপরতা, এটাকে ১৪ দলবিরোধী জোট বলা চলে। 

এক-এগারোর ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে

সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ২২ সেপ্টেম্বর মহানগর নাট্যমঞ্চে একটি নাটক অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধীদের লালনপালনকারী, বঙ্গবন্ধু খুনিদের সুযোগ-সুবিধা দানকারী, মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান দিয়ে রাজনীতি করেন যাঁরা এবং বর্ণচোরা এক-এগারোর সরকারের কুশীলবেরা একই মঞ্চে বসে নাটক করলেন। বিএনপিকে এখন জনবিচ্ছিন্ন নেতাদের ভাড়া করতে হচ্ছে—এটা বড়ই দুর্ভাগ্য। এমনকি তারা এখন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে মাইনাস করার জন্য মাঠে নেমেছে।

ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের উদ্দেশে নাসিম বলেন, ‘জোট-মহাজোট করে নির্বাচন করুন, কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে নতুন করে কোনো চক্রান্ত ও ফন্দি করবেন না। এটা আমরা সহ্য করব না।’ পরে মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যর্থ, হতাশ রাজনীতিবিদেরা কেন মাঠে নেমেছেন, এটাই আমাদের দুশ্চিন্তা। তাঁদের আরও করুণ পরিণতি হবে।’

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি জোট মনে হয় ‘বৃহত্তর ঐক্য’ প্রক্রিয়াকে তাদের ক্ষমতার পথের কাঁটা মনে করছে। কারণ, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি তারা ‘ওয়াকওভার’ পেয়েছিল। তিনি বলেন, ‘এবার আমরা বলছি, নির্বাচনটাও আমাদের জন্য আন্দোলন। ফলে আর ওয়াকওভার পাবে না। আর এমনটা হলে তখন তারা জিততে পারবে না, এটা জানে। এ জন্যই হয়তো ঐক্য প্রক্রিয়ার বিরোধিতায় নেমেছে।’