বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ওপর ক্ষুব্ধ বন বিভাগ

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উদ্ধার হওয়া কচ্ছপ। ফাইল ছবি
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উদ্ধার হওয়া কচ্ছপ। ফাইল ছবি

বন্য প্রাণী পাচারের ঘটনায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ এলাকায় কক্ষ বরাদ্দ ও পাস ইস্যু নিয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ওপর ক্ষুব্ধ বন বিভাগ। আকাশপথে বন্য প্রাণী পাচার রোধে নজরদারি বাড়াতে ছয় বছর ধরে এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার চিঠি দিয়েও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে বন বিভাগের।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জীববৈচিত্র্য, বন ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধানে বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ কার্যকর করা হয়েছে। এই আইনের ৩১ ধারায় বন্য প্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ইউনিট গঠন করা হয়েছে।

এই ইউনিটের কর্মকর্তারা দেশি-বিদেশি বন্য প্রাণী পাচার রোধ, টহল, তদারকিতে দেশের বিমানবন্দর, স্থলবন্দর ও সমুদ্রবন্দরগুলোয় নিয়োজিত। রাজধানী ঢাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিগার সুলতানা ও সালমা আক্তার নামে দুই বন্য প্রাণী পরিদর্শক এই দায়িত্ব পালন করছেন।

বন বিভাগের অভিযোগ, বিমানবন্দরে প্রবেশের জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (সিভিল অ্যাভিয়েশন) পাস না পাওয়া ও কার্গো ভিলেজে কক্ষ না পাওয়ায় এই দুই পরিদর্শক যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। কক্ষ বরাদ্দ ও পাসের আবেদন করে ছয় বছর ধরে একাধিক বার বন বিভাগের পক্ষ থেকে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। অথচ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলেই নিচ্ছে না।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিদর্শক নিগার সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে স্ক্যানের সময় কেস বার্ড, ম্যাকাও বা ছোট কোনো প্রাণী শনাক্ত হলে সিভিল অ্যাভিয়েশন বা শুল্ক কর্মকর্তারা খবর দিলে আমরা সেগুলো জব্দ করি। কিন্তু পাস ও কক্ষ না পাওয়ায় আমাদের নজরদারির সুযোগ নেই। কার্গো ভিলেজে যাওয়ার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে পাস পাওয়া যায়। কার্গো ভিলেজে যাওয়ার পরও তদারকি করা যায় না। কোনো প্রাণী জব্দের পর পরবর্তী কার্যক্রমও করা যায় না। সেখানে বসার জন্য একটি চেয়ারও পাওয়া যায় না।’

নিগার সুলতানা বলেন, ‘কক্ষ বরাদ্দ, পাসের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রায় ২০টি আবেদন আমি নিজে পৌঁছে দিয়েছি। অথচ ছয় বছরেও এই সমস্যার সমাধান হয়নি।’

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পরিচালক (এয়ার ট্রাফিক সার্ভিস) নূরুল ইসলাম দাবি করেন, বন বিভাগের জন্য কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া আছে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে বন বিভাগের জন্য একটি কক্ষ রয়েছে। তবে সেটি তারা ব্যবহার করে কি না, তা জানা নেই আমার।’

কক্ষ বরাদ্দপ্রাপ্তির কোনো চিঠি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বন বিভাগের কাছে আসেনি বলে জানিয়েছেন বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক মিহির কুমার দো। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বিমানবন্দরে কক্ষ পাওয়ার ব্যাপারে বন বিভাগকে কিছু জানায়নি কর্তৃপক্ষ। তবে এ ব্যাপারে তাঁদের সঙ্গে আমরা আবার কথা বলব।’

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল নাঈম হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রাণীসংক্রান্ত বিষয়টি শুল্ক কর্তৃপক্ষ ও বন বিভাগের। এটা সিভিল অ্যাভিয়েশন সম্পর্কিত না। কক্ষ বরাদ্দের জন্য বিমান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বন বিভাগ কথা বলতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই।’

২০১২ থেকে ২০১৮ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত সাড়ে ছয় বছরে বাংলাদেশের এই প্রধানতম বিমানবন্দর থেকে ৮ হাজার ২৪৭টি বন্য প্রাণী আটক করেছে বন বিভাগের বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট। এই ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, বন্য প্রাণী পাচারকারীরা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বন বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, পাচারকারীরা আফ্রিকার খামারে জন্ম নেওয়া বন্য প্রাণীগুলোকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ হয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। এখান থেকে সীমান্তপথে ভারত, চীন, ভুটান ও নেপালে এসব বন্য প্রাণী পাচার করা হয়। ভারত, চীন, নেপাল ও ভুটানে ব্যক্তিগত খামারে এসব প্রাণীর চাহিদা রয়েছে। তা ছাড়া বন্য প্রাণীর চামড়া ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করা হয়। চীনে বাঘ, সিংহের চামড়া দিয়ে ব্যাগসহ বিভিন্ন শৌখিন জিনিসপত্র তৈরি করা হয় এবং বন্য প্রাণীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে তৈরি ওষুধ মানুষের শরীরে ব্যথা নিরাময়ের কাজে ব্যবহার করা হয়।

২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে বিশ্বজুড়ে বন্য প্রাণী পাচারের ক্ষেত্রে বিশেষ নজরদারি বা ফোকাস দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম আসে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশসহ ২৬টি দেশে বন্য প্রাণী নিয়ে তিন ধরনের অপরাধ হচ্ছে। দেশগুলো থেকে বন্য প্রাণী পাচার হচ্ছে, বন্য প্রাণী পাচারের পথ বা রুট হিসেবে এসব দেশের ভূখণ্ড ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ওই সব দেশে পাচার হওয়া বন্য প্রাণী ব্যবহৃত হচ্ছে।

২৬টি দেশ হলো: বাংলাদেশ, ব্রাজিল, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ক্যামেরুন, চীন, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, কঙ্গো, গ্যাবন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কেনিয়া, লাওস, মাদাগাস্কার, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া, ফিলিপাইন, দক্ষিণ আফ্রিকা, তানজানিয়া, থাইল্যান্ড, টোগো, উগান্ডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ভিয়েতনাম।

বন্য প্রাণী পাচারে রুট হিসেবে বাংলাদেশের নাম থাকার বিষয়ে বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক মিহির কুমার দো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইউএস এইডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বন বিভাগের এ নিয়ে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। এ বছর দুবার তাঁরা বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন।