সাবেক দুই পরিচালকসহ ৭১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র

মিথ্যা তথ্য ও জাল অনাপত্তি সনদ দেখিয়ে সরকারি কর্মকর্তা নন এমন নাগরিকদের ‘অফিশিয়াল পাসপোর্ট’ দেওয়ার ঘটনায় করা মামলায় অভিযোগপত্র দিচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক দুই পরিচালকসহ ঘটনায় ৭১ জনকে এতে আসামি করা হয়েছে।

দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন এ অনুমোদন দেয়। শিগগিরই বিচারিক আদালতে এ অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হবে।

যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হচ্ছে তাঁরা হলেন: পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পরিচালক (বরখাস্ত) মো. মুন্সী মুয়ীদ ইকরাম ও এস এম নজরুল ইসলাম; সহকারী পরিচালক (বরখাস্ত) এস এম শাহজামান, দুই উচ্চমান সহকারী (বরখাস্ত) মো. শাহজাহান মিয়া ও মো. সাইফুল ইসলাম; বর্তমান দুই সহকারী পরিচালক উম্মে কুলসুম ও নাসরিন পারভীন নুপুর এবং নিউইয়র্কে বাংলাদেশ মিশনের পাসপোর্ট ও ভিসা উইংয়ে কর্মরত মো. আনোয়ারুল হক।

এ ছাড়া পাসপোর্ট গ্রহণকারী ৬৩ জনকেও আসামি করা হয়েছে। এরা হলেন ফেনির মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম, মানিকগঞ্জের দৌলতপুরের মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, নওগাঁর আত্রাইয়ের সাইদুর রহমান, মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার মোহাম্মদ রেজাউল করিম, ঢাকার নবাবগঞ্জের সোহেল রানা, ফরিদপুর সদরের শহিদ শেখ, ফেনির আনোয়ার হোসেন শরীফ, সিলেটের বিয়ানীবাজারের আমিন উদ্দিন, মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন, এম এন সাওন সাদেক, গোলাপগঞ্জের দেলোয়ার হোসেন, মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের মোহাম্মদ আরিফ হাসান, শ্রীনগরের মোহাম্মদ দিপু, সদরের ইমরান হোসেন, টংগীবাড়ির মো. ফরহাদ খান, কুমিল্লার লাঙ্গলকোটের কাজী মো. আল আমিন, হোমনার এস এম হিমেল, সুনামগঞ্জের ছাতকের হাবিবুর রহমান, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের মো. হানিফ শিবলু, সহিদ কামাল, ফরিদপুরের মধুখালির মোহাম্মদ কামরুজ্জামান, কুমিল্লা সদর দক্ষিণের সেন্টু চন্দ্র বিশ্বাস, মো. জসিম উদ্দিন, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া সদরের মোহাম্মদ আরিফ খলিফা, শিবলী আহম্মেদ, বাঞ্জারামপুরের ফারুখ আহমেদ, টাঙাইলের আব্দুল বারেক, নোয়াখালির সোনাইমুড়ির ইয়াসিন আরাফাত, ঢাকার নবাগঞ্জের তুষার খান, পাবনার সাঁথিয়ার মোহাম্মদ শামীম হোসেন।

টাঙাইলের মির্জাপুরের মনির খান, সাভারের মোহাম্মদ শাহ জালাল, হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের মোহাম্মদ মামুন, মুন্সিগঞ্জ সদরের মিলন বেপারী, সিলেটের গোলাপগঞ্জের শাহজাহান আহমেদ, কুমিল্লার জামাল উদ্দিন, সোনাইমুড়ির সামছুদ্দিন, নওগাঁর মো. জালাল মোল্লা, গোলাপগঞ্জের মুজিবুর রহমান, বরিশালের উজিরপুরের মো. আমির হোসেন শরিফ, কুমিল্লার মনোহরগঞ্জের মোহাম্মদ বাবর উদ্দিন, চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের মোহাম্মদ কামরুল হাসান, লক্ষ্মীপুরের রাশেদ খান, বিয়ানীবাজারের মোহাম্মদ ফয়েজ আহম্মেদ, যশোরের মোহম্মদ জামাল উদ্দিন, কুমিল্লার লাঙ্গলকোটের মো. জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়া, ঢাকার কেরানীগঞ্জের মো. বিল্লাল মিয়া, লাকসামের মাহফুজুর রহমান সবুজ, দাউদকান্দির মো. মিজানুর রহমান, সিলেটের কানাইঘাটের আফজল চৌধুরী, মাগুরার ইসমাইল হোসেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আলাউদ্দিন মিয়া, রানা আব্দুল মান্নান, সিলেটের গোলাপগঞ্জের কোয়েস আহমেদ, জুয়েল আহমেদ, মোহাম্মদ মান্নান, কানাইঘাটের মামুন রশিদ, বিয়ানীবাজারের মোহাম্মদ শফিকুল আলম মান্না, নারায়ণগঞ্জের মো. ইব্রাহিম খলিল, সিলেটের মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন, কুমিল্লার শহিদুল ইসলাম মজুমদার, মুন্সিগঞ্জের মো. রাকিব মিয়া এবং কুমিল্লার মুরাদনগরের মোহাম্মদ ইসমাইল সরকার।

দুদক সূত্র জানায়, এ ঘটনায় ২০১৬ সালের ১৯ জুলাই রাজধানীর শের বাংলা নগর থানায় মামলা করেন দুদকের উপপরিচালক বেনজীর আহমেদ। মামলায় ২১ জনকে আসামি করা হয়।
এজাহারে বলা হয় আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়ার সই জাল করে ১৮ জনের নামে অনাপত্তিপত্র তৈরি করেন। পরে পাসপোর্ট অফিসে জমা দিয়ে সাধারণ পাসপোর্টকে অফিশিয়াল পাসপোর্টে রূপান্তর করেন। ওই সব অবৈধ পাসপোর্টের মাধ্যমে পাসপোর্টধারীরা সরকারি কর্মচারী হিসাবে অবৈধভাবে তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে যান এবং পরবর্তীতে গ্রেপ্তার হয়ে দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে নষ্ট করেছেন। এনওসিগুলো জাল ও ভুয়া জানা সত্ত্বেও তা যাচাই না করে পরিচালক মুন্সী মুয়ীদ ইকরামসহ আসামিরা আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অফিশিয়াল পাসপোর্ট ইস্যু করেছেন।

মামলার তদন্ত করেন সহকারী পরিচালক শফি উল্লাহ। তদন্তে দেখা যায়, পাসপোর্ট বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীরা পরস্পর যোগসাজশে ৬৫টি অফিশিয়াল পাসপোর্ট তৈরি করে দিয়েছেন। মানবপাচারকারী চক্রের যোগসাজশে তাঁরা এ অপকর্ম করে নিজেরা বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন। একই সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন। তাই পাসপোর্ট বিভাগের আট কর্মকর্তার পাশাপাশি পাসপোর্ট গ্রহীতা ৬৫ জনও অপরাধ করেছেন। এদের মধ্যে দুজনের বিরুদ্ধে একই ঘটনায় মামলা হওয়ায় তাঁদের এই মামলায় আসামি করা হয়নি। আসামি করা হয়েছে ৬৩ জন পাসপোর্ট গ্রহীতাকে।

সরকারি কর্মকর্তা সাজিয়ে মানবপাচারের ঘটনাটি জানাজানি হয় তুরস্ক সরকারের এক চিঠির সূত্র ধরে। ২০১৫ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দেওয়া এক চিঠিতে তুরস্ক বাংলাদেশের সরকারি পাসপোর্ট ব্যবহারকারী তিনজনের একটি তালিকা পাঠায়। তুরস্কের পাঠানো ওই অভিযোগের পর বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে এর সত্যতা পায়। কোনো কোনো কর্মকর্তা এসব পাসপোর্টে স্বাক্ষর করেছেন, কারা সিল মেরেছেন, কার নির্দেশে তা তৈরি হয়েছে-এসব যাচাই-বাছাই করা হয়। তদন্ত শেষে ঘটনার সঙ্গে জড়িত চারজনকে চিহ্নিত করে অধিদপ্তর। তাঁরা হলেন পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মুন্সী মুয়ীদ ইকরাম, সহকারী পরিচালক এস এম শাহজাহান, উচ্চমান সহকারী মো. শাহজাহান মিয়া এবং মো. সাইফুল ইসলাম। এই চারজনকেই মিথ্যা তথ্য ও জাল অনাপত্তি সনদ দেখিয়ে সরকারি কর্মকর্তা নন এমন নাগরিকদের ‘অফিশিয়াল পাসপোর্ট’ দেওয়ার অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। একই সঙ্গে বিভাগীয় তদন্ত শুরুর নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন বিষয়টি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়।

অনুসন্ধান শেষে মামলা করার পরপরই দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হন মুন্সী মুয়ীদ ইকরাম ও উচ্চমান সহকারী সাইফুল ইসলাম।

জানা গেছে, জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা ওই সব পাসপোর্ট প্রথমে সাধারণ এমআরপি হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। পরে জাল কাগজপত্র দিয়ে সংশোধনের নামে সাধারণ পাসপোর্ট থেকে ‘অফিশিয়াল পাসপোর্ট’-এ রূপান্তর করা হয়। মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত একটি চক্র পাসপোর্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে ওই সব পাসপোর্ট তৈরি করে। প্রতিটি পাসপোর্টের জন্য নেওয়া হয় চার লাখ টাকা। প্রতিটি জাল পাসপোর্ট ফরম পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সব ফরম একই হাতে লেখা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২৭টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা স্মারক রয়েছে। এর আওতায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ওই সব দেশে যাওয়ার পর বিমানবন্দরেই (অনঅ্যারাইভাল ভিসা) ভিসা পেয়ে থাকেন। মানব পাচারকারীরা এই সুযোগ নিয়ে সাধারণ নাগরিকদের সরকারি কর্মকর্তা বানিয়ে বিদেশে পাচার করছেন। বিশেষ করে তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপসহ কয়েকটি দেশে অনেক লোককে অফিশিয়াল পাসপোর্টের মাধ্যমে পাচার করা হয়।
অনেকেই ভুয়া সরকারি কর্মকর্তা সেজে প্রথমে তুরস্ক, পরে সেখান থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চলে যান।