হাসপাতালে জরুরি ওষুধ থাকলে মৃত্যুহার কমে

>

হৃদ্‌রোগের চিকিৎসা দ্রুততম সময়ে করা না গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগীর জীবন বাঁচানো সম্ভব হয় না।

ক্যানসার, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্‌রোগ, শ্বাসতান্ত্রিক জটিলতার মতো অসংক্রামক ব্যাধি বাংলাদেশে বাড়ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অসুস্থতার কারণে দেশে বছরে যত মানুষের মৃত্যু হয় তার ৬০ শতাংশের জন্য দায়ী অসংক্রামক ব্যাধি। এর মধ্যে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে (হৃদ্‌রোগ) মৃত্যুর হার আবার অনেক বেশি। হৃদ্‌রোগের চিকিৎসা দ্রুততম সময়ে করা না গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগীর জীবন বাঁচানো সম্ভব হয় না।

হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুততম সময়ে চিকিৎসা দেওয়া অতি জরুরি বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। তাঁরা বলছেন, হাসপাতালে জীবন রক্ষাকারী (লাইফ সেভিং) ওষুধের সরবরাহ থাকলে হৃদ্‌রোগে মৃত্যুহার কমে। হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসায় স্টেপটোকাইনেস ইনজেকশনের ব্যবহার বেশ কয়েক বছর ধরে চলে আসছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত রোগীদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় এই ইনজেকশন সরবরাহের ক্ষেত্রে সময়ের হেরফের হলে মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক আফজালুর রহমান এবং তাঁর চার সহকর্মী ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত ৩০০ রোগীর ওপর এই গবেষণা করেছেন। এর মধ্যে ১৫০ রোগীকে জীবনদায়ী ইনজেকশন স্টেপটোকাইনেস হাসপাতাল থেকে সরবরাহ করা হয়েছিল। আর বাকি ১৫০ রোগীর আত্মীয়রা ওষুধটি বাইরে থেকে কিনে আনার পর ব্যবহার করা হয়েছিল। গবেষকেরা দেখেছেন, হাসপাতাল থেকে ইনজেকশন সরবরাহ করা রোগীদের মধ্যে মৃত্যুর হার ৭ শতাংশ। আর বাইরে থেকে এনে হাসপাতালে ব্যবহার করা রোগীদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার ১৫ শতাংশ। চিকিৎসকেরা বলছেন, ইনজেকশন দিতে সময় বেশি লাগায় মৃত্যুহার বেড়ে গেছে।

শরীরচর্চা না করা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ ও জীবনযাপনে অনিয়ম হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এই রোগ প্রতিরোধে কায়িক পরিশ্রম করা, হাঁটাহাঁটি করা, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, মাদক না নেওয়া, ধূমপান না করার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকেরা।

হৃদ্‌যন্ত্রের রক্তনালিতে রক্ত জমাট বেঁধে গেলে মানুষ হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়, যা স্বাভাকিভাকে হার্ট অ্যাটাক নামে পরিচিত। স্টেপটোকাইনেস ব্যবহারের পর জমাট রক্ত খুলে গিয়ে রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক হয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, হার্ট অ্যাটাকের ১২ ঘণ্টার মধ্যে ইনজেকশনটি প্রয়োগ করা সম্ভব হলে এর ফল পাওয়া যায়। তবে হার্ট অ্যাটাকের পরপরই যদি ইনজেকশনটি দেওয়া যায়, আরও বেশি ভালো ফল পাওয়া যায়।

অধ্যাপক আফজালুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, একটি ইসিজি করেই হার্ট অ্যাটাক কি না, শনাক্ত করা সম্ভব। ইসিজি করার পরপরই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা স্টেপটোকাইনেস ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু হাতের কাছে স্টেপটোকাইনেস থাকাটা খুব জরুরি।

হাসপাতালে আনার পর ৩০০ রোগীর মধ্যে ১৫০ জনকে স্টেপটোকাইনেস ইনজেকশন দিতে সময় লেগেছে ২৬ মিনিট। আর যাদের জন্য বাইরে থেকে এই ওষুধ কিনতে হয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে সময় লেগেছে ৭০ মিনিট। অর্থাৎ সময়ের পার্থক্য ৪৪ মিনিট। এই বাড়তি ৪৪ মিনিটকে চিকিৎসার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন চিকিৎসকেরা।

গবেষকেরা বলছেন, হার্ট অ্যাটাকের রোগীকে নিয়ে যখন হাসপাতালে আসেন স্বজনেরা, তখন অনেকের কাছে টাকাপয়সা থাকে না। স্টেপটোকাইনেস ইনজেকশনের দাম ৫ হাজার টাকা। গরিব রোগীর আত্মীয়ের কাছে এই টাকা থাকে না। আর মধ্যবিত্তের কাছেও তাৎক্ষণিকভাবে এই পরিমাণ অর্থ অনেক ক্ষেত্রে থাকে না। হাসপাতাল থেকে যখন ওষুধ কিনতে বলা হয়, তখন আশপাশের দোকানেও ওষুধটি পাওয়া যায় না। তখন আরও দূরের দোকান থেকে ওষুধ সংগ্রহ করতে অনেক সময় নষ্ট হয়।

তাই চিকিৎসকেরা বলছেন, প্রয়োজনের সময় ওষুধটি হাতের কাছে থাকতে হবে। অভিজ্ঞতা থেকে একাধিক চিকিৎসক বলেছেন, অন্য জেলা থেকে হৃদ্‌রোগের রোগী হাসপাতালে পৌঁছাতেই অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে যায়। তখন স্টেপটোকাইনেস দিলেও কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায় না।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা দেশের সব কটি বিভাগীয় শহরের হাসপাতাল এবং সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোয় স্টেপটোকাইনেস ইনজেকশন সরবরাহের ব্যবস্থা রাখার সুপারিশ করেছেন। একমাত্র জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এই ইনজেকশন বিনা মূল্যে রোগীদের দেওয়া হয়।

 গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের জুনিয়র কনসালট্যান্ট মো. আরিফুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ফরিদপুরের রোগীকে ঢাকায় না এনে যদি ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা দেওয়া যায়, তবে রোগীর মৃত্যুহার কমবে। রোগী ও রোগীর স্বজনদের ভোগান্তিও কম হবে। আর্থিক সাশ্রয়ও ঘটবে।