লাল-সবুজে সচেতনতা

সচেতনতার বার্তা নিয়ে খাগড়াছড়িতে। ছবি: প্রথম আলো
সচেতনতার বার্তা নিয়ে খাগড়াছড়িতে। ছবি: প্রথম আলো

এক প্রান্ত লাল, অন্য প্রান্ত সবুজ। কার্ড উঁচিয়ে লাল প্রদর্শন মানেই মাদক, যৌন হয়রানি, বাল্যবিবাহ, যৌতুক ও দুর্নীতিকে নিঃশব্দে ‘না’ বলা। নৈতিক শিক্ষা, সত্যবাদিতা, দেশপ্রেম ও মানবতাকে জীবনের ব্রত হিসেবে নিতে একইভাবে তুলে ধরতে হবে হাতের কার্ডের সবুজ অংশ। সবুজ মানেই শ্রেয়তর গুণাবলি। ছোট কার্ডটি যেন ভালো-মন্দের সহজাত নিয়মকেই প্রতিনিধিত্ব করছে। কার্ডের মাধ্যমে এমন সচেতনতার বার্তাই গত ছয় মাসে ৬৪ জেলার প্রায় ৫ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে পৌঁছে দিয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘লাল-সবুজ উন্নয়ন সংঘ’। সর্বশেষ আয়োজনটি ছিল কক্সবাজারের টেকনাফে। আগের দিন ৭ সেপ্টেম্বর ১৮৫তম দিনের কর্মসূচি ছিল কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের কলাতলী আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ে। সেখানেই আলাপ হলো উদ্যোক্তা কাওসার আলমের সঙ্গে।

লাল-সবুজের জয়যাত্রা

বাবার চাকরির সুবাদে সেনা কল্যাণ সংস্থা থেকে শিক্ষাবৃত্তি পেতেন কাওসার আলম আর তাঁর ছোট বোন। অনেক বছর সেই টাকা তোলা হয়নি। জমানো টাকা তোলার পর মনের সুপ্ত ইচ্ছেটা জেগে উঠল। কাওসার আলম মনে মনে ভাবছিলেন, শিক্ষার্থীদের সচেতনতামূলক একটি সংগঠন দাঁড় করানোর। তাঁর ভাবনার কথা জানালেন কয়েকজনকে। সাড়া মিলল অনেকেরই। সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করলেন সেই টাকায়। যাত্রা শুরু হলো ‘লাল-সবুজ উন্নয়ন সংঘ’।

২০১১ সালের কথা এটা। কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার পশ্চিম নোয়াদ্দা গ্রামের কাওসার আলম তখন একাদশ শ্রেণির ছাত্র। ওই বছরের ২৪ মে গঠিত সংঘের কেন্দ্রীয় সভাপতিও নির্বাচিত হলেন কাওসার আলম। তিনি বলছিলেন, ‘আমি বাবার কাছ থেকে মানুষের পাশে দাঁড়ানো আর সমাজের জন্য কিছু করার অনুপ্রেরণা পেয়েছি। তাই নিজের জমানো টাকা খরচ করতে কষ্ট হয়নি।’

কক্সবাজারের টেকনাফে মাদকের বিরুদ্ধে লাল কার্ড দেখাচ্ছে স্কুলশিক্ষার্থীরা, সঙ্গে আছেন কাওসার আলম (সামনে)
কক্সবাজারের টেকনাফে মাদকের বিরুদ্ধে লাল কার্ড দেখাচ্ছে স্কুলশিক্ষার্থীরা, সঙ্গে আছেন কাওসার আলম (সামনে)

এরপর প্রতিবছরই নানা কর্মসূচি হাতে নিতেন কাওসাররা। দিনে দিনে পরিসর বাড়তে থাকল। ২০১৫ সালে সংগঠনের মাধ্যমে সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে কাওসার আলম ঘুরলেন বেশ কয়েকটি জেলা। ২০১৭ সালের মধ্যে কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ দেশের ৪০ জেলায়  লাল-সবুজ উন্নয়ন সংঘের কমিটি হলো। সারা দেশে এই সংঘের সদস্যসংখ্যা এখন ১ হাজার ১০০। যাঁদের সবাই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া। এই শিক্ষার্থীরা প্রতি মাসে টিফিনের টাকা থেকে বাঁচিয়ে ১০ টাকা করে সংঘের তহবিলে জমা দেন। সেই টাকায় স্কুল-কলেজে চলে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে বাল্যবিবাহ, মাদক ও দুর্নীতিবিরোধী প্রচারণা। পাশাপাশি চলে  সুবিধাবঞ্চিত  শিশুদের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ ও  বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি।

সচেতনতার শুরু

স্কুলে স্কুলে ঘুরে অনেক শিক্ষার্থীর অনেক সমস্যার কথা শুনতেন কাওসার। তাদের কথাগুলো দায়িত্বশীল মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেই একটি কর্মসূচির পরিকল্পনা করছিলেন। সে ভাবনা থেকেই সচেতনতার কর্মসূচি—লাল-সবুজ। এ বছরের ৮ মার্চ পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার মাগুরমারী পমিজ উদ্দিন দাখিল মাদ্রাসা থেকে শুরু হয় এই কর্মসূচি। কাওসার আলম বলেন, ‘প্রথম দিন  প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থী মাদক, যৌন হয়রানি, বাল্যবিবাহ, যৌতুক ও দুর্নীতিকে “না” বলে লাল কার্ড প্রদর্শন করে। এটা শহরজুড়ে সাড়া ফেলে। মনে মনোবল জাগ্রত হয়। এরপর আরও উৎসাহ নিয়ে কাজে নেমে পড়ি।’

এক দিনের এই অনুষ্ঠান তিনটি ধাপে করা হয়। প্রথমে মতবিনিময় সভার মতো করে শিক্ষার্থীদের সমস্যার কথা শোনেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তাৎক্ষণিক সমাধানও বাতলে দেওয়া হয় অনেক জায়গায়। এরপর মাদকের বিরুদ্ধে শপথ করানো হয় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের, এরপরের পর্বে থাকে লাল-সবুজ কার্ড প্রদর্শন। এ কাজে  কাওসার আলমের নেতৃত্বে প্রতিটি জেলার ১০-১২ জন সদস্য অংশ নেন। উপস্থিত থাকেন জেলা প্রশাসক, স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা। লাল-সবুজ উন্নয়ন সংঘের উদ্যোগে দেশের ৬৪ জেলার ১১৭টি স্কুল, ১৫টি কলেজ ও ১৭টি মাদ্রাসায় অন্তত ৫ লাখ শিক্ষার্থী বাল্যবিবাহ, যৌন হয়রানি, মাদক ও দুর্নীতিবিরোধী শপথ নিয়েছে।

কাওসার আলম বললেন, ‘কক্সবাজারে কর্মসূচির ইতি টানতে পেরে আমরা খুশি।  সারা দেশের শপথ নেওয়া ৫ লাখ শিক্ষার্থী যদি মাদক, যৌন হয়রানি, বাল্যবিবাহ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকে, তাহলে বাংলাদেশ সোনার বাংলায় পরিণত হবে। লাল-সবুজ উন্নয়ন সংঘের প্রত্যাশাও তাই।’