বদির গদি নড়াতে মাঠে ৬ জন

আবদুর রহমান বদি, শাহজাহান চৌধুরী, মোহাম্মদ আলী ও সোহেল আহমেদ
আবদুর রহমান বদি, শাহজাহান চৌধুরী, মোহাম্মদ আলী ও সোহেল আহমেদ
>

• সাংসদ বদির বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ
• এবার নির্বাচনী মাঠের অবস্থা ভিন্ন
• বদির বিরুদ্ধে দলের ভেতর-বাইরে অনেকে
• সবার দাবি একটাই—বদিকে ঠেকাও
• ভোটারেরাও বিকল্প প্রার্থী খুঁজছেন

ইয়াবার উৎসভূমি হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি কক্সবাজারের মিয়ানমার সীমান্তের টেকনাফ ও উখিয়ার। এ দুই উপজেলা নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদের কক্সবাজার-৪ আসন। গুরুত্বপূর্ণ এ আসনের সাংসদ আওয়ামী লীগের আবদুর রহমান বদি। বিতর্কিত এ নেতাকে এবার ঠেকাতে এককাট্টা দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্য নেতারা।

সাংসদ বদি ইয়াবা বড়ি চোরাচালান, মানব পাচার ও রোহিঙ্গাদের অবৈধ আশ্রয়–প্রশ্রয়দাতার তালিকায় নাম লিখিয়েছেন অনেক আগে। সরকারি কর্মকর্তা, প্রকৌশলী, শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা, ব্যাংকার, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পিটিয়েও আলোচিত-সমালোচিত তিনি।

এই সাংসদকে ঠেকাতে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন আওয়ামী লীগের নতুন-পুরোনো মিলিয়ে ছয়জন সম্ভাব্য প্রার্থী। তাঁরা উখিয়া ও টেকনাফকে ইয়াবার উৎসভূমির দুর্নামে জড়ানোর জন্য দায়ী করছেন সাংসদ বদিকে। এখানকার ভোটারও এলাকাকে মাদকমুক্ত রাখতে ও এই দুর্নাম ঘোচাতে তাঁর বিকল্প প্রার্থী খুঁজছেন।

বদির বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে ঝুলছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দুর্নীতি মামলার ঝক্কিও। মামলায় তাঁর তিন বছরের সাজা হয়েছে। দুই দফায় ৩৫ দিন কারাবাসও করেছেন। তবু ছাড়েননি নির্বাচনী মাঠ। সময় পেলেই ছুটে যান এলাকায়। চাল, নগদ টাকা, কাপড়চোপড় বিতরণ করে স্থানীয় মানুষকে নিজের পক্ষে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এ অবস্থায় সুবিধায় আছে বিএনপি। তাদের প্রার্থী একজন। 

বদির বিকল্প কে
২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ আলীকে ৪১ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে সাংসদ হন বিএনপির প্রার্থী শাহজাহান চৌধুরী। তিনি পেয়েছিলেন ৮৯ হাজার ৭৪৭ ভোট। তাঁকেই ২০০৮ সালের নির্বাচনে ২৪ হাজার ৩১৩ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে সাংসদ হন আবদুর রহমান বদি। বদি পেয়েছিলেন ১ লাখ ৩ হাজার ৬২৬। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী তাহা ইয়াহিয়াকে ৯৮ হাজার ২১৬ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে বদি দ্বিতীয়বার সাংসদ হন। বদি পেয়েছিলেন ১ লাখ ৫ হাজার ৪৮৯ ভোট। সে সময় তাহা ইয়াহিয়া বদির বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির অভিযোগ করেছিলেন।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল ও তৃণমূল পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এবার নির্বাচনী মাঠের অবস্থা ভিন্ন। বদির বিরুদ্ধে দলের ভেতর-বাইরে শত্রু অনেক। সবার দাবি একটাই, ‘ইয়াবার গডফাদার’ বদিকে ঠেকাও।

টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হারুন সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, বদি টেকনাফকে ইয়াবার উৎসভূমিতে পরিণত করেছেন। বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এ কারণে ভোটাররা বিকল্প প্রার্থী খুঁজছেন।

টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ইউনুস বাঙ্গালী বলেন, কোন্দলে জর্জরিত দল। তাই প্রার্থীও অনেক। বদি ভোট নিয়ে ব্যস্ত হলেও আওয়ামী লীগ নিয়ে ভাবেন না। দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও তাঁর সমন্বয় নেই।

দলের মনোনয়ন পেতে সম্প্রতি মাঠে নেমেছেন নতুন তিনজন প্রার্থী। তাঁরা হলেন উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও হলদিয়াপালং ইউপির চেয়ারম্যান শাহ আলম, তাঁতী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যকরী সভাপতি ও উখিয়ার বাসিন্দা সাধনা দাশ গুপ্তা এবং জেলা যুবলীগের সভাপতি ও টেকনাফের বাসিন্দা সোহেল আহমদ বাহাদুর।

গণসংযোগ, পথসভার পাশাপাশি নতুন এ তিন প্রার্থীই এলাকায় রঙিন পোস্টার ও বড় বড় বিলবোর্ড টাঙিয়ে ভোটারদের দোয়া চাইছেন। এলাকাকে ইয়াবামুক্ত রাখার অঙ্গীকার করছেন। প্রচারণায় তাঁরা ইয়াবার গডফাদার থেকে ভোটারদের দূরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন।

এ ছাড়া পুরোনো মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে মাঠে সক্রিয় আছেন সাবেক সাংসদ ও টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী, উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হামিদুল হক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী।

সোহেল আহমদ দাবি করেন, ভোটারদের চাপে পড়ে তিনি মাঠে নেমেছেন। ইয়াবার কারবার বন্ধ করতে হলে বদির বিকল্প প্রার্থী দরকার।

শাহ আলম বলেন, মরণনেশা ইয়াবাসহ মাদকের বিস্তার রোধ ও মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করার লোক প্রয়োজন। তাই তিনি মাঠে নেমেছেন। মনোনয়নের ব্যাপারে তিনি আশাবাদী।

সাধনা দাশ গুপ্তা বলেন, টেকনাফ-উখিয়ার মানুষ কিছু লোকের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। জনগণকে এ জিম্মিদশা থেকে মুক্ত করতে তিনি দলের মনোনয়ন চাইবেন। তাঁর আগে এলাকায় মাদকবিরোধী পোস্টার সেঁটে তিনি জনমত গঠন করছেন। ইয়াবা চোরাচালান নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় বদিসহ তাঁর পরিবারের অন্তত ৩০ জনের নাম আছে। দেশব্যাপী চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে ‘ইয়াবার গডফাদার’ হিসেবে বদিকে নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু বদি এসব লেখালেখিকে অপপ্রচার বলে চালাচ্ছেন। গালমন্দ করছেন গণমাধ্যম ও সাংবাদকর্মীদের।

জানতে চাইলে সাংসদ বদি প্রথম আলোকে বলেন, সুবিধাবাদী কিছু নেতার কারণে আওয়ামী লীগে এই বিভক্তি। এই নেতারা তাঁর ও তাঁর পরিবারের লোকজনের বিরুদ্ধে ইয়াবা চোরাচালানের অপবাদ রটাচ্ছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইয়াবা চোরাচালানির তালিকায় নাম থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রকৃত ইয়াবা ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা খেয়ে সরকারি কিছু কর্মকর্তা ইয়াবা ব্যবসা করেন না এমন লোকজনের নাম তালিকায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন, যার কোনো ভিত্তি নেই। 

সুবিধায় বিএনপি
বরাবরের মতো এবারও বিএনপির প্রার্থী দলের জেলা সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী। এর আগে তিনি এ আসন থেকে চারবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। ছিলেন সংসদের হুইপও।

শাহজাহান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, দুদকের মিথ্যা দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। অথচ দুর্নীতির আসল মামলায় সাজাপ্রাপ্ত সাংসদ বদি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এক দেশে দুই আইন দেখে ভোটাররা হতাশ। টেকনাফের ইয়াবায় দেশ সয়লাব হলেও রাজার কিছুই হচ্ছে না। রাজার হাত অনেক লম্বা।

উখিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি সরওয়ার জাহান চৌধুরী বলেন, বিএনপি নির্বাচনে গেলে এ আসনের প্রার্থী হবেন শাহজাহান চৌধুরী। তাঁর বিকল্প প্রার্থী দলে নেই।