৫৭ ধারা না থাকলেও আগের মামলা চলবে

>
  • ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মামলার সংখ্যা ৭৫ টি।
  • চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মামলা ৩৮ টি।
  • শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মাস আগস্টে মামলা হয়েছে ২২ টি।
  • ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি মামলা করছে পুলিশও
  • আন্দোলন দমানোর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ।

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের বহুল আলোচিত ৫৭ ধারায় মামলা নেওয়ার আগে দেশের সব থানাকে পুলিশ সদর দপ্তরকে জানানোর নির্দেশ দেওয়া ছিল। অপপ্রয়োগ হচ্ছে, এ সমালোচনার মুখে সরকার এ নির্দেশ দেয়। কিন্তু নির্দেশ তো মানাই হয়নি, বরং মামলার পরিমাণ আরও বেড়েছে। আর সেসব মামলা করেছেন খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই।

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের অন্যতম বিতর্কিত ধারা ছিল ৫৭। তবে এই ধারা ব্যবহার করে হয়রানির অভিযোগ জানিয়ে আসছিলেন মানবাধিকারকর্মীরা। তখন সরকার বলেছিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন চালু হলে ৫৭ ধারার ঝামেলা আর থাকবে না। সরকার নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করেছে। তবে এই আইনেই ৫৭ ধারার উপাদানগুলো যুক্ত করা হয়েছে। ফলে নতুন করে হয়রানির আশঙ্কা যেমন আছে, তেমনি ৫৭ ধারায় আগে যে মামলাগুলো দায়ের হয়েছে, সেগুলোর বিচারও চলবে।

মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাবে এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ‘হয়রানিমূলক’এমন মামলা হয়েছে ৩৮ টি। ২০১৪ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত মামলার সংখ্যা ছিল কমপক্ষে ৭৫ টি। সে সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় প্রধান, মন্ত্রী ও সাংসদদের নামে ‘কটূক্তি, ক্যারিকেচার করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ভাবমূর্তি নষ্ট করার অভিযোগে তাঁদের পক্ষে মূলত আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মামলা করেছিলেন। আসামি ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।

তবে চলতি বছরে মামলা দায়ের করা হয়েছে মূলত নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। শুধু আগস্টেই ২২টি মামলা হয়েছে। বিভিন্ন মামলার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাইদুল ইসলাম, কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করা শিক্ষার্থীদের সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের তিন যুগ্ম আহ্বায়ক, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গর্ভবতী শিক্ষক ও ব্যবসায়ী।

তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের নিজস্ব সূত্র থেকে মামলার রেকর্ড রেখেছে। তবে মূল রেকর্ডটি পুলিশের হাতে এবং পুলিশ সদর দপ্তর আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কতগুলো মামলা হয়েছে তা প্রকাশ করতে চাইছে না। ঢাকায় পুলিশের সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ দমন বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, ডিএমপি বাদী হয়ে পাঁচটি মামলা করেছে। র‍্যাব ও কয়েকজন ব্যক্তিও আলাদাভাবে কিছু মামলা করেছেন।

ডিএমপির সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ দমন বিভাগের উপকমিশনার মো. আলিমুজ্জামান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মামলা দায়ের করেছে। মামলার তদন্ত চলছে। ফরেনসিক পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পেলে পুলিশ অভিযোগপত্র জমা দেবে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একটি সূত্র অবশ্য প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে যে আন্দোলন, সেটি দ্বিতীয় দিনেই ছাত্রদের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল বলে পুলিশ খবর পাচ্ছিল। এরপর শিক্ষার্থী হত্যা ও ধর্ষণের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে—এ আশঙ্কা থেকে দ্রুত কিছু মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়।

৫৭ ধারায় ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে মিথ্যা ও অশ্লীল, নীতিভ্রষ্টতা বা অসৎ, মানহানি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি—এই সাতটি শব্দকে অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি এ ধরনের অপরাধ করলে সর্বোচ্চ ১৪ বছর এবং সর্বনিম্ন ৭ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

ভুক্তভোগীরা যা বলছেন
খ্যাতিমান আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে ৫ আগস্ট ধানমন্ডির বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার প্রায় ১২ ঘণ্টা পর মামলা করে পুলিশ। তাঁর অপরাধ, ছাত্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আল-জাজিরায় সাক্ষাৎকার ও ফেসবুক টাইমলাইনে বিভিন্ন পোস্ট। তবে জামিন আবেদনের বিরোধিতা করতে গিয়ে পুলিশের যুক্তি ছিল, আইয়ুব খানের মন্ত্রিসভার সদস্য খান-এ-সবুর আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের নানির আপন ছোট ভাই, ‘বহুল কাঙ্ক্ষিত’ বাংলাদেশের উন্নয়নকাজে অংশ না নিয়ে তিনি বিদেশে চলে গেছেন, তাঁর আর্থিক লেনদেনের হিসাবে অস্বচ্ছতা আছে এবং বিদেশ থেকে আসা তহবিল তিনি সরকারবিরোধী কাজে ব্যবহার করে থাকতে পারেন।

শহিদুল আলমের স্ত্রী রেহনুমা আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভিযোগগুলো হাস্যকর পর্যায়ের মিথ্যা। আত্মীয় তো পছন্দ করে নেওয়ার সুযোগ নেই। তা ছাড়া দেশ সেনা সরকারের দখলে, এই যুক্তিতে শহিদুল উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাই দেননি। শহিদুল যখন লন্ডনে পড়তে যান তখন তাঁর বয়স ১৭ বছর। পারিবারিক সিদ্ধান্তে তাঁকে যেতে হয়েছে।’ তিনি মনে করেন, হয়রানির উদ্দেশ্যেই এ মামলা করা হয়েছে।

তবে পুলিশ পরিবারের এসব দাবি মানতে রাজি নয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) উপকমিশনার মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তের স্বার্থে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির পারিবারিক পূর্ব ইতিহাস এবং কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করতে হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মাইদুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ইফতেখারুল ইসলাম। অভিযোগ, তিনি প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করেছেন। অন্তর্বর্তীকালীন জামিন শেষে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের পর তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সহকর্মী ও গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক খ আলী আর রাজী বলছিলেন, হলে থাকা-খাওয়ার অব্যবস্থাপনা নিয়ে এবং একটি শব্দ নিয়ে ঠাট্টা করে পোস্ট দিয়েছিলেন। কোনো বিবেচনাতেই সে দুটিকে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কটূক্তি বলা যায় না।

না বুঝেই মামলার ফাঁদে
পটুয়াখালীর কলাপাড়ার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা নুসরাত জাহান ওরফে সোনিয়া। ইনবক্সে আসা একটি ফেসবুক পোস্ট তিনি তাঁর দেয়ালে শেয়ার করেন। ৪ আগস্ট দিবাগত রাতে গর্ভবতী নুসরাতকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। উসকানি দিয়ে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির দায়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

ধানমন্ডির একটি কফি শপের মালিক ফারিয়া মাহজাবীনের আইনজীবী জাহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ফারিয়া মেসেঞ্জারে একটি ভয়েস ক্লিপ পাঠিয়েছিলেন তাঁর বান্ধবীর কাছে। তিনি গুজব ছড়ানোর উদ্দেশ্যে ওই মেসেজ পাঠাননি। কিন্তু সেই যুক্তি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শোনেনি। অভিনেত্রী নওশাবা আহমেদও ফেসবুক লাইভে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পর বার্তাটি ভুল ছিল জানিয়ে পাল্টা আরেকটি ভিডিও লাইভ দেন। তাঁকেও জেল খাটতে হয়েছে। এখনো ঝুলছে ৫৭ ধারার খড়্গ।

আবার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের বিতরণ করা ছাগল মারা গেছে—ফেসবুকে এমন পোস্ট দেওয়ায় ৫৭ ধারায় করা মামলায় কারাগারে যেতে হয়েছিল খুলনার সাংবাদিক আবদুল লতিফ মোড়লকে।

এক যাত্রায় দুই ফল
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মঞ্চ বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক লুৎফুন্নাহার লুমা ওরফে লুমা সরকার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে শিক্ষার্থী খুন ও ধর্ষণের গুজব রটিয়ে একটি ভিডিও আপ করা হয়েছিল। এরপরই আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন বলতে শুরু করে ওই ভিডিও লুৎফুন্নাহারের। এরই জের ধরে ১৫ আগস্ট ভোর ৪টার দিকে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থেকে পুলিশ তাঁকে তুলে আনে। জামিনে মুক্ত লুৎফুন্নাহার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যদি আমার ফেসবুকে পোস্টের জন্য পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে, তাহলে আমাকে নিয়ে যেসব গ্রুপ বা যারা অপপ্রচার চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কেন পুলিশ ৫৭ ধারায় মামলা করে না?’

৫৭ ধারায় করা একাধিক মামলা লড়ছেন আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। প্রথম আলোকে গতকাল তিনি বলেন, শুরু থেকেই এই ধারার প্রতিটি মামলা হয়েছে হয়রানির উদ্দেশ্যে। এখন পর্যন্ত সঠিক কোনো কারণে মামলা হয়েছে বলে তাঁর জানা নেই। আর যাঁরা বলছিলেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হলে ৫৭ ধারা বাতিল হয়ে যাবে, আসলে তা হয়নি। রয়ে গেছে। তিনি মনে করেন, আন্দোলন দমানোর কৌশল হিসেবে আইনের এই ধারাটি ব্যবহার হয়েছে।

এদিকে সূত্রগুলো বলছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গেছে। এখন নির্বাচন সামনে রেখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কে কী পোস্ট দিচ্ছেন, কারা লাইক দিচ্ছেন বা শেয়ার করছেন, পোস্টদাতার সঙ্গে কার কার যোগাযোগ, সেটাও দেখা হচ্ছে।