ফ্ল্যাটের দাম বেড়েছে ১২ গুণ, বৈষম্যও প্রকট

ঢাকায় মানুষ আসে ‘বানের লাহান’। সবার চাই মাথা গোঁজার ঠাঁই। যাঁরা একটু সামর্থ্যবান, তাঁরা চান নিজের ফ্ল্যাট। কিন্তু ফ্ল্যাটের দাম তো আকাশছোঁয়া। ১৮ বছর আগে যে ফ্ল্যাটের দাম ছিল ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা, এখন সেটির দাম কোটির কাছাকাছি।

আবাসন ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এলাকাভেদে গত ১৮ বছরে ফ্ল্যাটের দাম বেড়েছে চার থেকে ১২ গুণ পর্যন্ত। এতে সাধারণ মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন। আবার দামভেদেও প্রকট হয়েছে এলাকাভিত্তিক বৈষম্য।

আস্ত বাড়ি নয়, এর পরিবর্তে ফ্ল্যাট কেনার সংস্কৃতি চালু হয়েছিল মূলত আশির দশকে। তারপরও আস্তে আস্তে তা আরও পোক্ত হয়েছে। শুরুতে এই খাতে ব্যবসায়ীর সংখ্যা কম থাকলেও চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সংখ্যাও বেড়েছে। আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সালে ১১টি প্রতিষ্ঠান মিলে সংগঠনটি গঠিত হয়। এখন এর সদস্যসংখ্যা এক সহস্রাধিক।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ঢাকার কাঠামো পরিকল্পনার (খসড়া) অনুযায়ী, ঢাকায় মোট আবাসের মাত্র ৭ শতাংশের জোগান দিয়েছে সরকার। ৫১ দশমিক ১৫ শতাংশ বাড়ি ব্যক্তি উদ্যোগে বানানো হয়েছে। বাকি ৪১ দশমিক ৮৫ শতাংশ ভবনই তৈরি করেছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা।

দাম বেড়েছে ১২ গুণ
শেল্‌টেক্‌ ও অন্যান্য আবাসন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, দেড় যুগে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে বারিধারা এলাকায়। এখানে ২০০০ সালে প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের দাম ছিল ২ হাজার ১৫০ টাকা। ২০০৫ সালে বেড়ে হয় চার হাজার টাকা। আর এখন প্রতি বর্গফুটের দাম অন্তত ২২ হাজার টাকা। দাম বেড়েছে অন্য সব এলাকাতেই। মিরপুরে ২০০০ সালে প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের দাম ছিল ১ হাজার ৫০০ টাকা, এখন চার গুণ বেড়ে হয়েছে ছয় হাজার টাকা।

এমন মূল্যবৃদ্ধিকে অসহনীয় বলছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তাঁর মতে, এটি অসহনীয় তবে অস্বাভাবিক নয়। জমির দুষ্প্রাপ্যতা ও একশ্রেণির মানুষের অস্বাভাবিক আয় বৃদ্ধি এর কারণ। আর রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন জমি ও নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করেছেন।

শেল্‌টেকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে (জুন মাস) নির্মাণসামগ্রীর দাম কয়েক গুণ বেড়েছে। প্রতিটি ইটের দাম পৌনে চার গুণের বেশি বেড়েছে, প্রকারভেদে বালুর দাম বেড়েছে প্রায় পৌনে দুই গুণ থেকে পাঁচ গুণ, সিমেন্টের দাম বেড়েছে প্রায় দুই গুণ এবং রডের দাম বেড়েছে অন্তত তিন গুণ।

ফ্ল্যাটের বর্তমান বাজার মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে আছে কি না, জানতে চাইলে আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, প্রতি বর্গফুট যখন দুই হাজার টাকায় বিক্রি হতো, তখনো ফ্ল্যাট মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে ছিল না। এখনো নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু নির্মাণসামগ্রী বা জমির মূল্যবৃদ্ধিই ফ্ল্যাটের মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী নয়। এর পেছনে বেহিসেবি টাকার প্রভাব আছে। আর সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে গোটা শহরে সমানভাবে উন্নয়ন না হওয়ায় এবং সামাজিক অবস্থানের (স্ট্যাটাস) কারণে এলাকাভিত্তিক বৈষম্য বেড়েছে।

বৈষম্যের চিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা গেছে, ধানমন্ডিতে ২০০০ সালে ২ হাজার ৪০০ টাকা (প্রতি বর্গফুট) দামে ফ্ল্যাট পাওয়া যেত। গুলশানে তখন প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের দাম ছিল ২ হাজার ৪৫০ টাকা, বনানীতে ২ হাজার ২০০ টাকা, বাড়িধারায় ২ হাজার ১৫০ টাকা, শান্তিনগরে ১ হাজার ৯০০ টাকা। এখন ধানমন্ডিতে ফ্ল্যাট কিনতে প্রতি বর্গফুটের জন্য প্রায় ১৪ হাজার টাকা, গুলশানে ১৮ হাজার টাকা, বনানীতে ১৩ হাজার ৫০০ টাকা আর শান্তিনগরে ৭ হাজার টাকার মতো ব্যয় হচ্ছে। এসব এলাকায় ফ্ল্যাটের দাম বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০০ সালে সব এলাকাতেই ফ্ল্যাটের দামে তেমন বৈষম্য ছিল না। কিন্তু দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এলাকাভিত্তিক বৈষম্যও প্রকট হয়েছে। ২০০০ সালে মোহাম্মদপুর ও বারিধারায় প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের দামে পার্থক্য ছিল মাত্র ৩০০ টাকা। এখন সেই প্রতি বর্গফুটে হয়েছে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা।

জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, জমির মূল্যবৃদ্ধি ও এলাকার আবেদন এই বৈষম্যের মূলে। মোহাম্মদপুরে যে হারে জমির দাম বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি হারে বারিধারায় জমির দাম বেড়েছে। আর এলাকার আবেদন নির্ভর করে পরিকল্পনা ও নাগরিক সেবার ওপর।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ হু হু করে ফ্ল্যাটের দাম বাড়ার পেছনে কালোটাকার প্রভাবকেও দায়ী করেছেন। মধ্যবিত্তরা যাতে ফ্ল্যাট কিনতে পারেন, সে জন্য সরকারি উদ্যোগের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন। তিনি বলেন, এ জন্য সরকারকে জমি বরাদ্দ ও নিবন্ধন ফি কমাতে হবে। ব্যাংকগুলোরও স্বল্প সুদে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণসুবিধা দিতে হবে।

কর নীতি মধ্যবিত্তের পক্ষে নয়
ফ্ল্যাট কেনার কর নীতিতেও মধ্যবিত্তের জন্য কোনো সুখবর নেই। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ১ হাজার ১০০ বর্গফুটের কম আয়তনের ফ্ল্যাট কেনায় মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। আগে দেড় শতাংশ ভ্যাট দিতে হতো, এখন ২ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। এতে ৫০ লাখ টাকার একটি ফ্ল্যাট কেনায় অন্তত ২৫ হাজার টাকা বেশি ভ্যাট দিতে হয়।

কালোটাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কেনার সুযোগও রাখা হয়েছে। পাঁচ বছর আগে বাজেটে আয়কর অধ্যাদেশের ১৯ বিবিবিবিবি নামের একটি নতুন ধারা সংযোজন করে অপ্রদর্শিত আয় দিয়ে ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ দেওয়া আছে। এর ফলে কালোটাকার মালিকেরাই ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ পাচ্ছেন।

চলতি বাজেট অনুযায়ী, গুলশান, বনানী, বারিধারা, মতিঝিল ও দিলকুশা এলাকায় এখনো প্রতি বর্গমিটারে ১ হাজার ৬০০ টাকা কর দিতে হয়। ধানমন্ডি, ডিওএইচএস, মহাখালী, লালমাটিয়া, উত্তরা, বসুন্ধরা, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় এই কর ১ হাজার ৫০০ টাকা এবং ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি এবং চট্টগ্রাম সিটির অন্য এলাকার জন্য কর এক হাজার টাকা।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান সামগ্রিক বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান আবাসন নীতি অতি ধনীর পক্ষে। এই শহরে যে দামের ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে, তা মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে নেই। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে যে আয় হয়, তা দিয়ে এত দামি ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব নয়। আবাসন ব্যবসায়ীরাও মধ্যবিত্তের জন্য ফ্ল্যাট বানান না। কিন্তু ২০০৮ সালে যখন আবাসন নীতিমালা করা হয়েছিল, তাতে একটি ভবনে মধ্যবিত্তের জন্য বর্গফুটপ্রতি দাম তিন থেকে চার হাজার টাকার মধ্যে কিছু ফ্ল্যাট রাখার শর্ত রাখা হয়েছিল। কিন্তু পরে সেটা বাতিল করা হয়। আবার গৃহঋণ নিয়ে মধ্যবিত্তের পক্ষে ফ্ল্যাট কেনাও সম্ভব নয়। গৃহঋণ মধ্যবিত্তের জন্য সারা জীবনের একটি বোঝা। এসব কারণে আবাসন নিয়ে এই শহরে বাস করা নাগরিকদের বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে।