রাজনীতি এখন নির্বাচনমুখী

জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার এক মাস বাকি। বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না, সে বিষয়ে এখনো পরিষ্কার সিদ্ধান্ত না জানালেও দলটি ভেতরে-ভেতরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ লক্ষ্যে নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি ও দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের কাজ এগিয়ে রাখছে বিএনপি। আওয়ামী লীগ বিভিন্ন জেলায় সাংগঠনিক সফরসহ মহানগরে নির্বাচনী গণসংযোগ করছে। এ ছাড়া বাম দল ও ইসলামি দলগুলোও নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জাতীয় ঐক্যের কথা বলে আসছে। এ বিষয়ে দলটি যুক্তফ্রন্ট, নাগরিক ঐক্য ও ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে আলাপ-আলোচনাও করেছে। ঐক্য সৃষ্টির লক্ষ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির জ্যেষ্ঠ কয়েকজন নেতা জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নাগরিক সমাবেশে যোগ দেন। এরপর আর সেভাবে ঐক্য প্রক্রিয়ার বিষয়টি এগোয়নি।

নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপি অক্টোবরে মাঠ দখলের কথা বলেছিল। গত ৩০ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করে বিএনপি। ওই সমাবেশ থেকে ৩ অক্টোবর দেশের সব জেলা শহরে সমাবেশ শেষে জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদান ও ৪ অক্টোবর সব মহানগরে সমাবেশ করে বিভাগীয় কমিশনার বরাবর স্মারকলিপি দেওয়ার ঘোষণা দেয় দলটি। যদিও ৩ অক্টোবর ঠাকুরগাঁও ও মুন্সিগঞ্জে পুলিশি বাধায় বিএনপির সমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। এ ছাড়া হবিগঞ্জ ও রংপুরেও বিএনপির সমাবেশে বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটে।

বিএনপির একটি সূত্র বলছে, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি মাঠে নেই, সত্য। কিন্তু নির্বাচনের জন্য বিএনপি প্রস্তুত হচ্ছে। প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া ও জোটের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির বিষয়েও কাজ চলছে। এ কারণে সপ্তাহে অন্তত চার দিন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বসছেন। তাঁরা নিজেদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছেন এবং নির্বাচন বিষয়ে সম্ভাব্য করণীয় কী হতে পারে, সে বিষয়েও তাঁরা আলোচনা করছেন।

এ বিষয়ে গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরউল্লাহ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি তো বিভিন্নভাবে মাঠে নামার চেষ্টা করেছে। সরকার মাঠে নামতে দিচ্ছে না। সরকার একদিকে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে, আরেক দিকে সুষ্ঠু নির্বাচনের পয়লা শর্ত, কথা বলতে দেওয়া, সভা-সমিতি করতে দেওয়া—সরকার এসব করতে দিচ্ছে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনের জন্য বিএনপি প্রস্তুত। বিএনপি দুই কদম করে বাড়লে আওয়ামী লীগ এককদম করে পেছাচ্ছে। বিএনপি নির্বাচনে আছে। আওয়ামী লীগ নির্বাচন করে কি না, সেটাই দেখার বিষয়। আওয়ামী লীগ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে, এমন হলে তো নির্বাচন করা মুশকিল।

বিএনপির একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিক—এমনটাই চাইছে কমনওয়েলথ। সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে লেখা এক চিঠিতে সংস্থাটির মহাসচিব প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড এ কথা বলেছেন। প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড লিখেছেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপিকে উৎসাহিত করছি। কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অপরিহার্য।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচনে যাওয়ার জন্য আমাদের সমস্ত প্রস্তুতি আছে। কিন্তু আমরা একটি ন্যূনতম পরিবেশ চাই, যে কারণে আমরা কিছু দাবি দিয়েছি। সেসব দাবি আদায়ের জন্য আমরা এই মুহূর্তে আন্দোলন করছি, রাজপথে থাকছি।’

আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ বিএনপির কর্মকাণ্ড বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন নিয়ে প্রচণ্ড দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে বিএনপি। এভাবে তারা নিজেদের ক্ষতি করছে। বিএনপির আন্দোলন করার শক্তি নেই। তাই বিএনপির উচিত হবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া। এভাবে আন্দোলন-আন্দোলন করে নিজেদের হাস্যকর করে তোলার কী প্রয়োজন?

নির্বাচন বিষয়ে বাম দলগুলোও গত ১৮ জুলাই জোট গঠন করেছে। সিপিবি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) খালেকুজ্জামান, বাসদ (মার্ক্সবাদী), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন—এই আট দল মিলে জোট গঠন করে।

বাম দলগুলোর জোট প্রসঙ্গে সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ বা বিএনপির সঙ্গে কোনো মেরুকরণে যাবে না সিপিবি। তিনি বলেন, ‘এক দুঃশাসন শেষ হলে আরেক দুঃশাসন এসে পড়ে। তিন দশক ধরে আমরা এই অবস্থায় আছি। এই দুঃশাসনের দুষ্টুচক্র ভাঙতে হবে।’ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, পরিস্থিতি বুঝে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে এখন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে তাঁরা আন্দোলন করবেন। এ ছাড়া প্রয়োজন হলে তাঁরা নির্বাচন বয়কট করতে পারেন, আবার অংশও নিতে পারেন। অংশ নিলে বামজোট ও প্রগতিশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে তাঁরা ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবেন।

নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে। তফসিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক প্রচার, সভা-সমাবেশ সবকিছু নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। এরপর নিয়ন্ত্রিতভাবে রাজনৈতিক প্রচারের বাইরে তেমন কিছু করার থাকবে না রাজনৈতিক দলগুলোর। তফসিল ঘোষণার বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তফসিল ঘোষণা করার মতো প্রস্তুতি আছে নির্বাচন কমিশনের। কমিশন তারিখ নিয়ে এখনো ওইভাবে আলোচনা করেনি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ডিসেম্বরের শেষার্ধে অথবা জানুয়ারির প্রথম দিকে জাতীয় নির্বাচন হবে।

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ জোরেশোরে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছে। উত্তরবঙ্গ, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে সাংগঠনিক সফর শেষে এখন সপ্তাহব্যাপী নির্বাচনী গণসংযোগ করছে আওয়ামী লীগ। ১ থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকা মহানগরে নির্বাচনী এই গণসংযোগ কর্মসূচি চলবে। গণসংযোগের জন্য দলের চারজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, দীপু মণি ও মাহবুব উল আলম হানিফের নেতৃত্বে চারটি দল গঠন করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। এসব দল একেক দিন রাজধানীর একেক এলাকায় গণসংযোগ কার্যক্রম চালিয়ে জনগণের কাছে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে নৌকা মার্কায় ভোট চাইছে।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক প্রথম আলোকে বলেন, গণসংযোগের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা গেছে। মানুষ এখন নির্বাচনমুখী। মানুষ এখন সচেতন। দেশের যেকোনো ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণ অংশ নেবে এবং ভোট দেবে বলে আওয়ামী লীগ দৃঢ়ভাবে আশাবাদী।

গণসংযোগের বাইরে এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের তেমন কোনো কর্মসূচি হাতে নেই। নির্বাচন সামনে রেখে কেন্দ্রীয় ১৪ দলের বাইরে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগ জোট করবে কি না, এ বিষয়েও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি দলটি। এ বিষয়ে গত বুধবার গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জোট বাড়ানোর বিষয়ে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। দল ও শরিক দলের নেতাদের সঙ্গে বসে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করা যাবে বলে তিনি জানান।

এ ছড়া ইসলামি দলগুলোও নির্বাচনে যাওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। বেশ কয়েকটি দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। যদিও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এখনো তাদের কিছু জানানো হয়নি। তবে ইসলামি দলগুলো নির্বাচন প্রশ্নে নিজেদের প্রস্তুত করছে।

জাতীয় পার্টি সরকারে ও বিরোধী দলে উভয় ভূমিকায় থাকলেও দলটি এবার নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দর-কষাকষি করছে। জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের কাছে ১০০ আসন চাইছে। আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে, একাদশ জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টি যদি জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করে, তাহলে জাতীয় পার্টিকে ৪০ থেকে ৫০টি আসন ছেড়ে দেওয়া হতে পারে। তবে জাতীয় পার্টি বেশি আসন নেওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাবে বলে দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।