নিয়ম নয়, উপাচার্যের ইচ্ছাই সব

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উপাচার্যের জন্য বানানো বাড়ি। টাঙ্গাইলের সন্তোষে।  ছবি: প্রথম আলো
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উপাচার্যের জন্য বানানো বাড়ি। টাঙ্গাইলের সন্তোষে। ছবি: প্রথম আলো
>
  • মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য এক কাজের জন্য তিনবার সম্মানী নিয়েছেন।
  • ক্যাম্পাসে বাড়ি থাকলেও থাকেন না তিনি।
  • অধ্যাপক নিয়োগে অনিয়ম
  • শিক্ষার্থীদের আবাসন-সংকট
  • মেয়াদ পার হলেও বহাল রাখা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী পর্ষদ রিজেন্ট বোর্ড

একটি কাজের জন্য একজন ব্যক্তি কতবার সম্মানী পেতে পারেন? যাঁরা ভাবছেন একবার, তাঁরা ভুল করছেন। একটি কাজ করে তিনবার সম্মানী নিয়েছেন টাঙ্গাইলে অবস্থিত মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আলাউদ্দিন। কেবল অতিরিক্ত সম্মানী নেওয়া নয়, শিক্ষকদের পদোন্নতি, কর্মকর্তা নিয়োগসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় নিয়মকানুনের চেয়ে তাঁর ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছাই প্রধান বলে অভিযোগ করেছেন অন্য শিক্ষকেরা।

২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় থেকে উপাচার্য হিসেবে মো. আলাউদ্দিন সম্মানী নিয়েছেন ৬১ হাজার ৯৯০ টাকা। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন হিসেবে ভর্তি পরীক্ষার সময় ‘ডি’ ইউনিটের সমন্বয়কারীর দায়িত্বে ছিলেন। সে জন্য সমন্বয়কারীর সম্মানী নিয়েছেন ৪৫ হাজার ৫৯০ টাকা। আর ডিন হিসেবে নিয়েছেন ২ লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টাকা। একই কাজ করলেও তিনটি পদে দায়িত্বে থাকার কারণে সম্মানী বাবদ তিনি নিয়েছেন ৩ লাখ ৩৮ হাজার ৮০ টাকা।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ভর্তি পরীক্ষায় সাধারণত উপাচার্যরা একটি সম্মানী নিয়ে থাকেন। উপাচার্যের দায়িত্বে থেকে আবার ডিন পদের জন্য সম্মানী নেওয়াটা নৈতিকতার দিক থেকে ঠিক নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেছেন, প্রশাসনিক দায়িত্ব এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে নিয়ম নয় বরং নিজের ইচ্ছাকে বেশি প্রাধান্য দেন উপাচার্য। ভর্তি পরীক্ষায় একাধিক পদে থেকে টাকা নেওয়া, নিজের আত্মীয়স্বজনকে নিয়োগ, একাই বিভিন্ন পদে থাকা, মেয়াদোত্তীর্ণ রিজেন্ট বোর্ড (অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেট বলা হয়) বহাল রাখা, পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়ম ভেঙে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি, ডিন ও বিভাগীয় চেয়ারম্যান নিয়োগে বিভিন্ন অনিয়ম করেছেন উপাচার্য।

শিক্ষকদের আপত্তির মুখে অবশ্য গত বছর ভর্তি পরীক্ষার সময় উপাচার্য ও ডিন পদের বিপরীতে সম্মানী নিয়েছেন মো. আলাউদ্দিন। টাকার পরিমাণ ১ লাখ ৯১ হাজার ৭০০ টাকা।

এসব অনিয়মের বিষয়ে ১ অক্টোবর প্রথম আলো বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলে। এর পরদিনই ব্যবসায় শিক্ষা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন পদ ছেড়ে দেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকেরা বলছেন, এত দিন উপাচার্য বলতেন সংশ্লিষ্ট অনুষদে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন না বলেই তিনি দুটি অনুষদের ডিনের দায়িত্ব পালন করেছেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২ জন অধ্যাপক থাকার পরও দুজন কনিষ্ঠ সহযোগী অধ্যাপককে ডিন করেছেন তিনি।

অভিযোগের বিষয়ে উপাচার্য মো. আলাউদ্দিন বলেন, নিয়মের মধ্যে থেকেই তিনি কাজ করছেন। আর ভর্তি পরীক্ষার টাকা তিনি কাজ করেই নিয়েছেন, এতে দোষের কিছু দেখেন না। আর উপাচার্যের বাংলোতে উঠবেন বলে জানান তিনি। মেয়াদোত্তীর্ণ রিজেন্ট বোর্ড আগামী জাতীয় নির্বাচনের পর গঠন করা হবে বলে জানান তিনি।

এর আগে বিএনপি  ক্ষমতায় থাকার সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক খলিলুর রহমানের বিরুদ্ধেও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে চার বছরের মেয়াদ শেষ করার আগেই তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

টাঙ্গাইলের সন্তোষে মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৩ সালে। এখন পাঁচটি অনুষদে ১৫টি বিভাগে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। শিক্ষার্থী ৫ হাজার ৯০৬ এবং শিক্ষক ১৯৯ জন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. আলাউদ্দিন ২০১৩ সালের মে থেকে টানা দুই মেয়াদে উপাচার্যের দায়িত্বে আছেন।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ–উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ না থাকায় প্রশাসনিক সব ক্ষমতা উপাচার্যের হাতে বলে জানান শিক্ষকেরা। নাম না প্রকাশের শর্তে চারজন শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, পছন্দের কয়েকজন শিক্ষক-কর্মকর্তার ওপর উপাচার্য সব সময় নির্ভর করে চলেন। সর্বশেষ শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে উপাচার্যের অনুসারীরা পৃথক প্যানেল থেকে নির্বাচন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের মধ্যে এখন দুটি উপদল রয়েছে। এর জন্য উপাচার্যকে দায়ী করেন তাঁরা।

মাওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী পর্ষদ রিজেন্ট বোর্ডের মেয়াদ তিন বছর। কিন্তু চার বছরের বেশি সময় হয়ে গেলেও এই বোর্ড ভেঙে দেওয়া হয়নি।

শিক্ষক–কর্মকর্তাদের অভিযোগ, উপাচার্য তাঁর কয়েকজন আত্মীয়কেও বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী পদে স্থায়ীভাবে নিয়োগ দিয়েছেন। এর মধ্যে তাঁর ভায়রার ছেলেও রয়েছেন। তাঁদের একজন সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা।

বিভিন্ন বিভাগীয় চেয়ারম্যান পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। আইন অনুযায়ী, যদি কোনো বিভাগে অধ্যাপক না থাকেন তাহলে উপাচার্য জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সহযোগী অধ্যাপকদের মধ্যে থেকে পালাক্রমে একজন বিভাগীয় চেয়ারম্যান নিয়োগ দেবেন। কিন্তু এখনো ফার্মাসিসহ দুটি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এ বিষয়ে উপাচার্য বলেছেন, আগে থেকেই এমনটি হয়ে আসছে।

অধ্যাপক পদোন্নতিতে অনিয়ম

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পদোন্নতির নীতিমালা অনুযায়ী, সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক হওয়ার জন্য পিএইচডি থাকলেও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মোট ১২ বছরের সক্রিয় শিক্ষকতা বা গবেষণার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। থাকতে হয় বিভাগীয় ‘প্ল্যানিং কমিটির’ অনুমোদন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষক মো. সিরাজুল ইসলাম ২০০৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে ২০১৫ সালেই অধ্যাপক হয়েছেন। এ নিয়ে বিভাগীয় ‘প্ল্যানিং’ কমিটিতেও আপত্তি ছিল। দুজন শিক্ষক বললেন, অধ্যাপক সিরাজ এখন প্রক্টরের দায়িত্বে আছেন।

তবে সিরাজুল ইসলামের দাবি, নিয়ম মেনেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁকে পদোন্নতি দিয়েছে। শিক্ষকদের একটি অংশ তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছড়াচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

আবাসন–সংকটে শিক্ষার্থীরা, বাড়ি থাকলেও থাকেন না উপাচার্য

প্রায় ৬ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য পাঁচটি আবাসিক হলে মাত্র ১ হাজার ১৪০ জনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে বা টাঙ্গাইল শহরে বিভিন্ন মেসে থেকে লেখাপড়া করেন। এতে বাড়তি খরচ হচ্ছে তাঁদের।

আর উপাচার্যের জন্য দোতলা বাড়ি নির্মাণ করা হলেও থাকেন না তিনি। ২০১৫ সালে উপাচার্য মো. আলাউদ্দিন এই বাড়ির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৭ সালের মার্চে এর উদ্বোধন করেন তিনি। কিন্তু সেই বাড়িতে থাকেন না উপাচার্য। থাকেন উপাচার্য দপ্তরের পাশের একটি কক্ষে। এ জন্য ভাড়া দেন মাত্র ১ হাজার টাকা।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন শিক্ষক বলেন, উপাচার্য বাড়িতে না থাকলেও আসবাব কেনা হয়েছে। মূলত বাড়িভাড়ার টাকা যাতে না দিতে হয়, সে জন্যই উপাচার্য সেখানে থাকেন না। এটা অনৈতিক।