গ্রহণযোগ্যতার সংকটে বিএনপি

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার রায়ের পর তাৎক্ষণিকভাবে দু–তিনটি কথা বলা জরুরি। প্রথমত, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত লণ্ডনে নির্বাসিত বিএনপি  নেতা তারেক রহমানের উচিত দলের মূল কান্ডারির পদ থেকে এখনই সরে দাঁড়ানো। এটা রাজনৈতিক নৈতিকতার প্রশ্ন। বিএনপি সরকারের পরিবর্তন চায় কিন্তু রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নয়। তাই বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অধীনে একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কোনো রাজনৈতিক নেতার দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দলের চেয়ারম্যানের পদে আসীন থাকা মোটেই সমীচীন নয়।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের দাবি অনুযায়ী এটি ‘ফরমায়েশি রায়’ হলেও তাঁরা এই রায়ের বিরুদ্ধে ঠিকই আপিল করার ঘোষণা দিয়েছেন। আর তাই বিএনপি নেতার উচিত হবে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পদ থেকে ইস্তফা দেওয়া। পলাতক থাকার কারণে হাইকোর্টের রায় অনুসারে তারেকের কৈফিয়ত প্রকাশ করতে পারবে না সংবাদমাধ্যম। আপিলে যদি তারেক খালাস পান, তাহলে আবার তিনি স্বপদে ফিরে আসতে পারেন।

এর আগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দণ্ডিত হওয়ার পর গঠনতন্ত্রের দোহাই দিয়ে নাটকীয়ভাবে তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পদে বসানো হয়েছিল।

২০১৩ সালে দুর্নীতির মামলায় তারেক রহমানকে একটি বিচারিক আদালত নির্দোষ ঘোষণা করলে বিএনপি বলেছিল, রায়টি প্রমাণ করে যে, তারেক নির্দোষ এবং মামলাটি হয়রানিমূলক ছিল। বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে দুর্নীতির মামলায় সাজা হওয়ার অনেক উদাহরণ আছে। কিন্তু ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো বর্বরোচিত রাজনৈতিক পাশবিকতার সঙ্গে কোনো বিচারেরই তুলনা চলে না। বিএনপি এ থেকে কখনো নিস্তারও পাবে না।

দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার দায় বিএনপিকে সংগঠনগতভাবে নিতে হয়নি। কারণ, তখন বিএনপির জন্ম হয়নি। কিন্তু এবার দলটিকে দায় নিতেই হবে। কিন্তু কতটা তারা নেবে আর কতটা নেবে না, সেটা জানতে আমরা পূর্ণাঙ্গ রায় পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম। খুন ও সন্ত্রাসী রাজনীতির বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসতে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার রায় মাইলফলক। কিন্তু তাতে ব্যক্তির অবস্থান কার কী ছিল, তার চেয়েও আমরা অধীর আগ্রহে এটা জানার অপেক্ষা করব যে, শুধু জজ মিয়া নাটক সাজানোই নয়, ২১ আগস্টের অব্যবহিত দিনগুলোতে রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে কার কী ভূমিকা রাখার কথা ছিল, আর তখন কে কী ভূমিকা রেখেছিলেন। অপরাধীরা অপরাধের শাস্তি পেয়েছেন। কিন্তু ১৫ আগস্টের মতোই ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা শুধুই একটি মামুলি হত্যাকাণ্ড ছিল না। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পরে আমরা কিন্তু অনেকেই এটা বলেছি যে, রাষ্ট্র দু–তিন দশক পরে এসে বঙ্গবন্ধুর খুনের বিচার করেছে দণ্ডবিধির আওতায়। কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থার ভেতরে কার কী স্বাভাবিক ভূমিকা প্রত্যাশিত ছিল, বাস্তবে কে কী করেছিলেন, তার কোনো নির্মোহ সরকারি নথি বা প্রতিবেদন আজও তৈরি হয়নি। বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা কী ছিল, তা–ও গ্রন্থিত হয়নি। আমরা এটা মনে করি যে,১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সঙ্গে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের রাজনৈতিক যোগসূত্র খতিয়ে দেখা গুরুত্বপূর্ণ।

একজন বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক রায়ের পরপরই স্মরণ করেন যে, বিগত এক–এগারোর সরকারের সময় মুফতি হান্নানের জবানবন্দি প্রথম আলোয় প্রথমবারের মতো প্রকাশ পাওয়া একটি বড় ঘটনা ছিল। কারণ, তখনই সবার সামনে প্রথম উন্মোচিত হয়, বিএনপি ক্ষমতায় থাকতেই মুফতি হান্নান র‍্যাবের টিএফআই সেলে যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন, সেখানেই তাঁর স্বীকারোক্তি ছিল। অথচ তা আদালতের গোচরে না এনে গোপন করা হয়। আবার এটাও ঠিক যে, আফগান–পাকিস্তান সীমান্তে র‍্যাডিকালাইজ হওয়া মুফতি হান্নান বিএনপি আমলেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। সুতরাং সংগঠন হিসেবে বিএনপির রাজনৈতিক বৈধতার সংকট খুঁজতে বসে রাষ্ট্রের বৈধতার সংকটের দিকে চোখ বন্ধ রাখলে চলবে না। কারণ, রাষ্ট্র কী করে ক্ষমতাসীন সংগঠনে বিলীন হয়, সেটা আমরা ২১ আগস্টের ঘটনায় প্রত্যক্ষ করেছি। আমরা স্মরণ করতে পারি, মুক্তাঙ্গন থেকে সভাস্থল বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে সরিয়ে নেওয়ার মতো কারণ দেখিয়ে বিএনপি নিষ্ঠুরতার সঙ্গে বলেছিল, আওয়ামী লীগই এ ঘটনা ঘটিয়েছে!

১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা দায়েরের সময় জিয়াউর রহমানের কোনো সংশ্লিষ্টতা উল্লেখ না করায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান শেখ হাসিনার প্রশংসা করেছিলেন। একইভাবে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় খালেদা জিয়ার কোনো সংশ্লিষ্টতা বা সংশ্রব উল্লেখ না করতে সরকারের যে দৃষ্টিভঙ্গি, তা আমরা বিবেচনায় নেব। আজ আওয়ামী লীগ যখন কথিত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে বিএনপির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করবে, তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সন্ত্রাসী হামলায় ক্ষতবিক্ষত ব্যক্তিদের দ্রুত চিকিৎসাসেবা দিতে সর্বাত্মক মানবিক ভূমিকা পালন করেছিলেন কিনা, সেটা যেমন জানতে চাই, তেমনি রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো দুর্গতদের প্রাণে বাঁচাতে অথবা জজ মিয়া নাটক সাজাতে, তথ্য গোপনে এবং ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে কী করেছিল, তারও বিবরণ জানতে চাই। সত্য বটে, গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা সংস্থার দায়িত্বশীলরাও গুরুদণ্ড পেয়েছেন। কিন্তু তাতে ওই সংস্থাগুলোর চেইন অব কমান্ড কীভাবে কাজ করেছিল, তা জানার দরকারি কৌতূহল মেটায় না।

তাই এই ঘটনায় এবং ঘটনা ঘটার পরে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি কোনো মাঠে–ঘাটের, সভা–সেমিনারের বক্তৃতা–বিবৃতি হিসেবেই থাকা উচিত নয়। অনাগত প্রজন্মের জন্য এসব আমাদের লিখে রেখে যাওয়া উচিত। আমরা হয়তো এখনই সব ক্ষত নিরাময় করতে পারব না। কিন্তু ক্ষতগুলো লুকানো নয়, আড়াল করা নয়, চিহ্নিত ও উন্মোচিত হওয়া দরকার।

১৪ বছর পরে রাষ্ট্র যা করতে পেরেছে তা হলো, আরও ১০টা অপরাধের মতো এই মামলাটির আসামিরাও প্রাথমিকভাবে শাস্তি পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার প্রেক্ষাপটে এই অগ্রগতি ঘটেছে। ১৪ বছর পরে অপরাধীরা শাস্তি পেলেন। এখন এই রায়ে আদৌ কোনো ধরনের ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলে তার বিরুদ্ধে আপিল হবে। যে ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, তাঁদের আপিলের পর হাইকোর্টে দীর্ঘ শুনানি হবে।

তৃতীয় যে দিকটির কথা বলব, সেটা সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধতত্ত্ববিদদের কাজ। উপমহাদেশের খুনে রাজনীতি থেকে ২১ আগস্টকে আলাদা করা যায়। বঙ্গবন্ধু ও ভুট্টো হত্যাকাণ্ডে সামরিক বাহিনী, ইন্দিরা হত্যাকাণ্ডে উগ্র শিখরা, রাজীব হত্যাকাণ্ড ও চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা হত্যাচেষ্টায় এলটিটিই জড়িত। কিন্তু ২১ আগস্টে স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সংগঠনের নেতৃত্বকে নির্মূল করার চেষ্টা হয়েছিল।

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার রায় দেখাচ্ছে, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিরা সমষ্ঠিগতভাবে খুনে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়াতে পারেন। এটা একটা ভয়ংকর রাজনৈতিক-সামাজিক ব্যাধির নির্দেশক। এটি কেবলই একটি রায় বা শাস্তি কার্যকর করার মধ্য দিয়ে নিরাময়ের বিষয় নয়। এর পরিবর্তন হতে হবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার প্রতিহিংসামূলক বাসনা থেকে বেরিয়ে আসার মধ্য দিয়ে।

এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে,২১ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি স্থায়ী বিভক্তি রেখা টেনে দিয়েছে।