ভোট টানতে প্রকল্প পাসের 'উৎসব'

>

*শেষ সময়ে ঘন ঘন একনেক সভা ডেকে প্রকল্প পাস করা হচ্ছে
* ৩ মাসে পাস হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকার ১২৬ প্রকল্প
*ভোটার আকৃষ্ট করতে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে

বর্তমান সরকারের মেয়াদের শেষ সময়ে ভোটার আকৃষ্ট করতে প্রকল্প পাসের উৎসব শুরু হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই ১২৬টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়ে গেছে। এই তালিকায় রাস্তাঘাট, সেতুসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো তৈরির প্রকল্পই বেশি। আর প্রায় শতভাগই নতুন প্রকল্প। তবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) এসব প্রকল্পে কোনো বরাদ্দ নেই। এখন অন্য প্রকল্প থেকে টাকা এনে এসব নতুন প্রকল্পে বরাদ্দ দিতে হবে। মূলত ভোটারদের আকৃষ্ট করতেই রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।

আবার সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই প্রকল্পের কাজের উদ্বোধনও বেড়ে গেছে। এমনকি গুচ্ছ প্রকল্পের আওতায় এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট রাস্তাঘাট, সেতু, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দির নির্মাণকাজের উদ্বোধন করে চলেছেন অনেক মন্ত্রী, সাংসদ, মনোনয়নপ্রত্যাশীরা।

শেষ মুহূর্তে প্রকল্প পাসের জন্য তাড়াহুড়ো করে ঘন ঘন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা হচ্ছে। প্রতিটি একনেকে ১০ থেকে ২০টি প্রকল্প পাস হচ্ছে। সাধারণত মঙ্গলবার একনেক সভা হয়। চলতি সপ্তাহেই অনেকটা নজিরবিহীনভাবে দুটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত মঙ্গলবার একনেকে ২০টি প্রকল্প পাস হয়েছে। দুই দিনের মাথায় গতকাল বৃহস্পতিবার একনেকের সভা করে আরও ১৭টি প্রকল্প পাস করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও ২৬টি প্রকল্প একনেক সভার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। তা পাস করতে অন্তত দুটি একনেক সভা করতে হবে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের গত আগস্ট মাসে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে সব মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়। সেই সভায় এই সরকারের মেয়াদ থাকতেই প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে দ্রুত প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপরই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্প প্রস্তাব আসতে থাকে। আবার প্রকল্প পাসের পাশাপাশি মন্ত্রী-সাংসদেরাও নিজেদের এলাকায় শিক্ষা- প্রতিষ্ঠান, সড়ক, মসজিদ-মন্দিরসহ বিভিন্ন জনপ্রিয় অবকাঠামোর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করে চলেছেন। অনেকে নিজেদের ফেসবুক পেজে এসব প্রকল্পের কাজের উদ্বোধনের ছবি পোস্ট করে প্রচারণা চালাচ্ছেন। যদিও এসব প্রকল্পের অনেকগুলোতেই কোনো বরাদ্দ নেই।

শেষ সময়ে প্রকল্প পাসের হিড়িক সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ভোটারদের সমর্থন পাওয়ার জন্য এসব প্রকল্প পাস করা হচ্ছে। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, প্রকল্প পাস হলেই ভোটাররা সন্তুষ্ট। নিজের এলাকা সড়ক, স্কুল-কলেজ নির্মাণকাজের উদ্বোধন হলেই তাঁরা খুশি। উদ্বোধনের পর কখন এসব প্রকল্প শেষ হবে, তা নিয়ে ভোটার ও রাজনৈতিক নেতাদের তেমন মাথাব্যথা থাকে না।

মির্জ্জা আজিজের মতে, এসব প্রকল্পে এডিপি থেকে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হবে না। হয়তো প্রথম বছর পাঁচ কোটি টাকা লাগবে, দেওয়া হবে পাঁচ লাখ টাকা। এই পাঁচ লাখ টাকা খরচ করেই প্রকল্পের উদ্বোধন করা হবে। এতে সময়মতো প্রকল্প শেষ হবে না, খরচও বাড়বে। মূলত ভোটার আকৃষ্ট করতেই এসব প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।

১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গত জুলাই মাস থেকে গতকাল পর্যন্ত ১০টি একনেক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব একনেক সভায় পাস হওয়া ১২৬টি প্রকল্পে মোট খরচ হবে ১ লাখ ১২ হাজার ১১২ কোটি টাকা। প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৪০টি রাস্তাঘাট, সেতু, সুপেয় পানি, পয়োনিষ্কাশনসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের প্রকল্প। এর বাইরে স্কুল, মাদ্রাসাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের প্রকল্পও আছে।

সর্বশেষ গত এক মাসেই পাঁচ একনেকে ৮৩টি প্রকল্প পাস করা হয়। আর গত এক সপ্তাহে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার ৩৭টি প্রকল্প পাস করেছেন নীতিনির্ধারকেরা।

নির্বাচনের আগে এত প্রকল্প অনুমোদন কেন দেওয়া হচ্ছে—গতকাল বৃহস্পতিবার একনেক সভা শেষে সাংবাদিকদের কাছে এর ব্যাখ্যা দেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে বিপুল বিনিয়োগ দরকার। সাধারণত নির্বাচনের বছরে প্রবৃদ্ধি কমতি থাকে। নির্বাচনের সময়ে বেসরকারি বিনিয়োগ শ্লথ থাকে। তাই বর্তমান প্রবৃদ্ধির ধারা ধরে রাখতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো হচ্ছে। তিনি আরও জানান, তফসিল ঘোষণার পরও নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে প্রকল্প পাস করা যায়। তবে নির্বাচনী আইনে যতটুকু ক্ষমতা দেওয়া হবে, ততটুকুই প্রয়োগ করা হবে।

কেমন প্রকল্প

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জনতুষ্টিতে গত তিন মাসে নানা ধরনের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সাংসদেরা নিজের এলাকায় পছন্দমতো জায়গায় মাদ্রাসা তৈরি করবেন। আবার শহরের বস্তিবাসীরা পাবেন ফ্ল্যাট। এ ছাড়া সারা দেশের ১৮০টি উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের সড়ক মেরামতের বিশেষ প্রকল্পও রয়েছে।

গত ১১ সেপ্টেম্বর সাংসদদের জন্য ২ হাজার মাদ্রাসা নির্মাণে ৫ হাজার ৯১৯ কোটি টাকার প্রকল্প পাস হয়। বর্তমান সাংসদদের ইচ্ছায় তাঁদের নির্বাচনী এলাকায় কমপক্ষে ছয়টি করে মাদ্রাসা ভবন নির্মাণ করা হবে। এই প্রকল্পে আরও ২০০টি ভবন নির্মাণের টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কোনো সাংসদের যদি আরও মাদ্রাসা ভবন নির্মাণের প্রয়োজন পড়ে, তাঁকে ওই বাড়তি বরাদ্দ থেকে টাকা দেওয়া হবে। এর আগেও স্কুল ভবন, মসজিদ, মন্দির নির্মাণে আলাদা প্রকল্প পেয়েছেন সাংসদেরা। এ ছাড়া ৯ বছর ধরে নিজের এলাকায় রাস্তাঘাট নির্মাণের জন্য তাঁরা প্রতিবছর ৩ থেকে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়ে আসছেন।

সারা দেশের ১৮০টি উপজেলার রাস্তা মেরামতের জন্য ৯ অক্টোবর আরেকটি প্রকল্প পাস করা হয়। এতে ২ হাজার ২১০ কিলোমিটার উপজেলা সড়ক, ৪৯৫ কিলোমিটার ইউনিয়ন সড়ক নির্মাণ করা হবে। এর বাইরেও জেলাওয়ারি পল্লী অবকাঠামোর বেশ কয়েকটি প্রকল্প আছে। ওই প্রকল্পের মাধ্যমেও রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হবে।

শহর এলাকার বস্তিবাসীদের জন্য দুই রুমের ৫ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হবে। এতে খরচ হবে ৮২৬ কোটি টাকা। ১১ সিটি করপোরেশন ও ২৪টি পৌরসভা এলাকায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। সিটি করপোরেশনগুলো হলো ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর। পৌরসভাগুলো হলো সাভার, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, কালিয়াকৈর, চাঁদপুর, কক্সবাজার, ফেনী, নোয়াখালী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, পাবনা, শাহজাদপুর, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, মাগুরা, নোয়াপাড়া, সৈয়দপুর, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, ভোলা, ময়মনসিংহ ও জামালপুর।

চলতি অর্থবছরে ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকার এডিপি নেওয়া হয়েছে। ১ হাজার ৪৫২টি প্রকল্পে এই টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এখন একনেকে যেসব নতুন প্রকল্প পাস হচ্ছে, সেই প্রকল্পে বরাদ্দ দিতে হবে। এডিপিতে বরাদ্দহীন ও অননুমোদিত প্রকল্প আছে ১ হাজার ৩৩৮টি।