অনিরাপদ পানি পান করছে সাড়ে সাত কোটি মানুষ

>

*বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন
*দেশের পানীয় জলের নিরাপদ উৎসগুলোতে ব্যাকটেরিয়া ও আর্সেনিকের ভয়ংকর মাত্রায় উপস্থিতি রয়েছে।
*বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন
*পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন পরিস্থিতি
*৭.৫ কোটি মানুষ অনিরাপদ উৎসের পানি পান করেন
*৪১% পানির নিরাপদ উৎসগুলোয় রয়েছে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া
*১৩% পানিতে রয়েছে আর্সেনিক
*২৮% মানুষের সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়ার সুযোগ আছে
*৫% কম উন্নত পয়নিষ্কাশন সুবিধা পায় শহরের বস্তির বাসিন্দারা
*১০০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে টয়লেট আছে মাত্র ১ টি
*৩৫% শিশু বয়সের তুলনায় উচ্চতায় কম

দেশের প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষ অপরিচ্ছন্ন এবং অনিরাপদ উৎসের পানি পান করছে। পানির নিরাপদ উৎসগুলোর ৪১ শতাংশই ক্ষতিকারক ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়াযুক্ত। পাইপের মাধ্যমে বাসাবাড়িতে সরবরাহ করা পানিতে এই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৮২ শতাংশ।

বাংলাদেশের পানি সরবরাহ, পয়োনিষ্কাশন, স্বাস্থ্যবিধি ও দরিদ্রতা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। পানি, পয়োনিষ্কাশন, পরিচ্ছন্নতা এবং দারিদ্র্যের মধ্যে সংযোগ খুঁজে বের করতে বিশ্বের ১৮টি দেশে বৈশ্বিক গবেষণা করে বিশ্বব্যাংক। তার ভিত্তিতে ওই ১৮টি দেশের প্রতিটির জন্য আলাদা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

বাংলাদেশের জন্য তৈরি করা প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের পানীয় জলের নিরাপদ উৎসগুলোতে ব্যাকটেরিয়া ও আর্সেনিকের ভয়ংকর মাত্রায় উপস্থিতি রয়েছে। এসব উৎসের ৪১ শতাংশে ই-কোলাই এবং ১৩ শতাংশে রয়েছে আর্সেনিক। পাইপের মাধ্যমে নগরাঞ্চলে যে পানি সরবরাহ করা হয়, তাকে নিরাপদ মনে করা হলেও বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, পাইপলাইনের পানির ৮২ শতাংশেই রয়েছে ই-কোলাই। ৩৮ শতাংশ টিউবওয়েলের পানিতে পাওয়া গেছে এই ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া। পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহের জন্য ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়াকে দায়ী করা হয়।

প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর সিরিন জুমা বলেন, নিম্নমানের পানি এবং পয়োনিষ্কাশন–ব্যবস্থা দেশের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। এ দুটি বিষয় শিশুর পুষ্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের প্রায় ৩৫ শতাংশ শিশু বয়সের তুলনায় উচ্চতায় কম। নিরাপদ ও মানসম্মত পানি এবং পয়োনিষ্কাশন–ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হলে শিশুদের বেড়ে ওঠা এবং দেশের উন্নতি ত্বরান্বিত হবে।

ঢাকা ওয়াসার পরিচালক আবুল কাশেম বলেন, অনেক ক্ষেত্রে বাসাবাড়ির পয়োনিষ্কাশনের সংযোগে ছিদ্র থাকায় পানির সংযোগ মিশে যায়। এতে দূষণ হতে পারে। আবার অনেক সময় বাসাবাড়িতে পানি বিশুদ্ধ না করায় দূষিত উপাদান পাওয়া যেতে পারে। শোধনাগার বা উৎস থেকে বাসাবাড়িতে সরবরাহ পর্যন্ত পানির সংযোগ নিরাপদ করতে ওয়াসা কাজ করছে।

উন্মুক্ত স্থানে মলমূত্র ত্যাগ বন্ধ এবং শৌচাগার ব্যবহারে বাংলাদেশের ভূমিকা সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। তবে দেশে অনেক পরিবার বা খানার লোকজন একসঙ্গে ব্যবহার করে, এমন শৌচাগারের সংখ্যা এখনো বেশি। প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের পাঁচ কোটির বেশি মানুষ একাধিক পরিবারের সঙ্গে ভাগাভাগি করে শৌচাগার ব্যবহার করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গৃহস্থালিতে শৌচাগার ব্যবহার বাড়লেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে এখনো সেই সুবিধা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা শৌচাগারের ব্যবস্থা রয়েছে দেশের ৫০ শতাংশ স্কুলে। আর ১০০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শৌচাগার আছে একটি। ভালো শৌচাগার না থাকায় মাসিকের সময় প্রতি চারজনে একজন নারী শিক্ষার্থী স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। দেশের পাঁচটি বড় শহরের বস্তিতে বসবাসকারীরা পাঁচ গুণ কম পয়োনিষ্কাশন–সুবিধা পায়।

দারিদ্র্যের সঙ্গে নিরাপদ পানি সরবরাহ, উন্নত পয়োনিষ্কাশন–ব্যবস্থার সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে বিশ্বব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, আয়ের হিসাবে নিচের দিকে থাকা ৪০ শতাংশ জনগণ সুযোগ-সুবিধা কম পায়। বস্তিতে থাকা শিশুদের প্রায় অর্ধেক বয়সের তুলনায় কম উচ্চতার। পেটের বা অন্ত্রের পীড়ায় ধনীদের চেয়ে দরিদ্র লোকজন তিন গুণ বেশি ভোগে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের পানি সরবরাহ, পয়োব্যবস্থাপনা–সংক্রান্ত ব্যবস্থার উন্নয়নে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ চাহিদার তুলনায় কম। গত এক দশকে এই খাতে বাজেটে বরাদ্দ প্রায় অর্ধেক কমেছে। এই খাতগুলোর উন্নয়নে অনেক পরিবারের ভাগাভাগি করে একটি শৌচাগারের ব্যবহার কমানো, পরিবেশের দূষণ কমাতে পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা জোরালো করা, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে সুবিধাগুলো পৌঁছানো এবং গৃহস্থালির বাইরে পয়োনিষ্কাশন ও পরিচ্ছন্নতা পরিস্থিতির বিস্তার ঘটানোর সুপারিশ করা হয়েছে।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে প্রতিবেদনটির ওপরে প্যানেল আলোচনা হয়। তাতে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দেশে পয়োবর্জ্যের ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল। এই বর্জ্যকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা বিবেচনা করতে হবে। দেশের নৌ, রেল, বাস টার্মিনালে শৌচাগারের অবস্থা খুব করুণ। শহরে গণশৌচাগার প্রয়োজনের তুলনায় কম, ব্যবহারের অনুপযোগী। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।

অনুষ্ঠানে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রোকসানা কাদের, বিশ্বব্যাংকের প্র্যাকটিস ম্যানেজার তাকুয়া কামাতা, ওয়াটারএইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর খায়রুল ইসলাম প্রমুখ বক্তব্য দেন।