প্রতিবন্ধীদের সেবায় জনবল ও অবকাঠামোর ঘাটতি আছে

দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। তাদের চিকিৎসা ও অধিকার রক্ষায় দেশে একাধিক আইন আছে। কিন্তু অবকাঠামোজনিত সীমাবদ্ধতা ও জনবলের স্বল্পতার কারণে সবাইকে সেবার আওতায় আনা যাচ্ছে না। তবে এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। রোববার প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এ কথা বলেন।

‘একীভূত স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণে সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা’ শীর্ষক এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো। এই আয়োজনে সহায়তা করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডিজঅ্যাবল্ড রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন (ডিআরআরএ) ও খ্রিস্টিয়ান ব্লাইন্ড মিশন (সিবিএ)।

বৈঠকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হকসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পদস্থ কর্মকর্তা এবং দেশি–বিদেশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা অংশ নেন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, একটি সুস্থিত ও দৃঢ় সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের সেবা ও পুনর্বাসন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে। প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসাসেবা ও পুনর্বাসনের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা সায়মা ওয়াজেদের আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে বাংলাদেশের কাজ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, দেশে প্রায় দেড় কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধী। এদের শনাক্ত করা, চিকিৎসা দেওয়া ও পুনর্বাসন করা সরকারের একার কাজ নয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন ও সমাজের বিত্তশালীদের এই কাজে সরকারের সঙ্গে হাত মেলাতে হবে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মর্যাদা দিতে হবে। তাঁদের সেবায় সরকারি ও বেসরকারি সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক এ এইচ এম এনায়েত হোসেন বলেন, প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষাবিষয়ক ২০১৩ সালের আইনে ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতার উল্লেখ আছে। সব ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষের চিকিৎসার বিষয়গুলো চলমান স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাত কর্মসূচির কর্মপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং কাজ হচ্ছে। পুনর্বাসনসেবার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা বিভাগের যুগ্ম প্রধান মো. মহিউদ্দিন ওসমানি বলেন, সরকারের অসংক্রামক রোগ কর্মসূচিতে প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মানিকগঞ্জ, সাতক্ষীরা ও চট্টগ্রামের তিনটি উপজেলায় প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ ও চিকিৎসার বিষয়ে দিশারি প্রকল্প চালু হয়েছে। ওই প্রকল্পের অভিজ্ঞতা সারা দেশে কাজে লাগানো হবে।

অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (এনসিডি) বিষয়ভিত্তিক পরিচালক নূর মোহাম্মদ বলেন, সরকারি হাসপাতালে এনসিডি কেন্দ্রে প্রতিবন্ধীদের সেবা দেওয়া হয়। প্রতিবন্ধীদের প্রয়োজন ও চিকিৎসার ধরন এক নয়। তাঁদের চিকিৎসা পৃথক স্থানে হওয়া বাঞ্ছনীয়। তিনি বলেন, চিকিৎসকদের পাশাপাশি নার্স ও ওয়ার্ড বয়দেরও প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দরকার।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজি বিভাগের পরামর্শক মাজহারুল মান্নান বলেন, প্রতিবন্ধিতার চিকিৎসা, সেবা ও অধিকারের ব্যাপারে বাংলাদেশ বিশ্বে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। দেশের সম্পদের তুলনায় গত আট বছরে এ ব্যাপারে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। সরকারের পাঁচটি মন্ত্রণালয় এ নিয়ে কাজ করছে। তবে চিকিৎসকসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি মা–বাবাকে প্রশিক্ষণ ও সচেতন করার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।

মানিকগঞ্জের সিভিল সার্জন খুরশীদ আলম বলেন, জেলার উপজেলা হাসপাতালগুলোয় প্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এদের পৃথক কাউন্টারে নিবন্ধন করা হয়, যার প্রয়োজন, তাকে হুইলচেয়ার দেওয়া হয়, বহির্বিভাগে পৃথক কাউন্টারে ওষুধ দেওয়া হয়। এদের জন্য পৃথক শয্যা আছে। তিনি বলেন, সহায়ক উপকরণ ও জনবল–সংকটের কারণে অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না।

পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি) প্রায় চার দশক প্রতিবন্ধীদের সেবায় কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, প্রতিবন্ধীদের সেবা প্রদানকারী পেশাজীবীদের একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা প্রয়োজন। হাসপাতালগুলোয় পদ সৃষ্টি করাও দরকার।

সাতক্ষীরা থেকে এসেছিলেন মনোয়ারা খাতুন। তিনি নিজে প্রতিবন্ধী এবং প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করে এমন প্রতিষ্ঠান নারীকণ্ঠ উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নের জন্য যেসব উদ্যোগের কথা বলেন, তা সাতক্ষীরায় বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, তা দেখা দরকার।

চট্টগ্রামের পটিয়ার একটি কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার মো. নাসির উদ্দিন বলেন, অনেক প্রতিবন্ধীর পরিবার খুবই দরিদ্র। তাদের ইউনিয়ন পর্যায়ে সেবা দেওয়া যায় কি না, তা বিবেচনা করা দরকার।

সিবিএর কান্ট্রি ডিরেক্টর শাহনেওয়াজ কোরাইশী বলেন, প্রতিবন্ধীদের স্বাস্থ্যসেবা খুবই জরুরি বিষয়। স্বাস্থ্যসেবা পেলে প্রতিবন্ধী শিশুর শিক্ষার সুযোগ বাড়ে, তার দক্ষতা তৈরি হয়। সে কাজ করার সুযোগ পায়। সমাজে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ বাড়ে। ঠিক সময়ে স্বাস্থ্যসেবা না পেলে সে সমাজের মূলধারার বাইরে চলে যায়, বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

ইউনিসেফের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মারগুব আরেফ জাহাঙ্গীর বলেন, প্রতিবন্ধীদের মানবাধিকারের বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। তাদের বিশেষ ধরনের সেবা প্রয়োজন। সবার পক্ষে তা দেওয়া সম্ভব না।

প্রথম আলোর আয়োজনে ‘একীভূত স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণে সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা। এই আয়োজনে সহায়তা করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডিজঅ্যাবল্ড রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন (ডিআরআরএ) ও খ্রিস্টিয়ান ব্লাইন্ড মিশন (সিবিএ)। কারওয়ান বাজার, ঢাকা, ১৩ অক্টোবর। ছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলোর আয়োজনে ‘একীভূত স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণে সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা। এই আয়োজনে সহায়তা করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডিজঅ্যাবল্ড রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন (ডিআরআরএ) ও খ্রিস্টিয়ান ব্লাইন্ড মিশন (সিবিএ)। কারওয়ান বাজার, ঢাকা, ১৩ অক্টোবর। ছবি: প্রথম আলো

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। অনুষ্ঠানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনালের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে সব নাগরিককে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। তাতে পুনর্বাসনসেবায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, এই সেবা সবচেয়ে বেশি দরকার প্রতিবন্ধীদের। প্রতিবন্ধীদের সামাজিকভাবে একীভূত করার বিষয়গুলো কম গুরুত্ব পাচ্ছে।

আলোচনায় মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ডিআরআরএর নির্বাহী পরিচালক ফরিদা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, সাতক্ষীরার তিনটি উপজেলায় ৪৭ হাজার ১৬৫ জন প্রতিবন্ধী শনাক্ত করে তাদের স্বাস্থ্যসেবার আওতায় এনেছে ডিআরআরএ। তাদের ৫০ শতাংশের ক্ষেত্রে সহায়ক উপকরণ দরকার। এসব সহায়ক উপকরণ শুধু ঢাকাতেই কিনতে পাওয়া যায়।

ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ১৯৯৬ সাল থেকে তাঁরা প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করছেন। প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসার ব্যয় সাধারণ রোগীদের চেয়ে অনেক বেশি। তাঁরা নিজ জেলার বাইরে সেবা নিতে যেতে চান না। প্রতিবন্ধীদের স্বাস্থ্যসেবায় জাতীয় কর্মকৌশল, তাদের চিকিৎসায় ভর্তুকি ও জেলা পর্যায়ে সহায়ক উপকরণ তৈরির সুপারিশ করেন তিনি।