স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ নেই

চট্টগ্রাম নগরের পূর্ব ফিরোজশাহ কলোনির ধসে পড়া পাহাড়ের ১০ গজের মধ্যেই বসবাস করছে বাসিন্দারা। গতকাল দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটে।  ছবি: প্রথম আলো
চট্টগ্রাম নগরের পূর্ব ফিরোজশাহ কলোনির ধসে পড়া পাহাড়ের ১০ গজের মধ্যেই বসবাস করছে বাসিন্দারা। গতকাল দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটে। ছবি: প্রথম আলো

চট্টগ্রামে প্রতিবছর পাহাড়ধসে প্রাণহানি ঘটছে। তারপরও পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি দিন দিন বাড়ছে। ঝুঁকিপূর্ণ বসতি রোধে প্রশাসন মাইকে সতর্ক করে এবং সেবা–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেই দায়িত্ব সারে। ২০০৭ সালে অবৈধ দখলদারদের স্থায়ীভাবে উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হলেও তার কোনো বাস্তবায়ন হয়নি।

সবশেষ গত শনিবার রাতে ভারী বর্ষণের সময় নগরের পূর্ব ফিরোজশাহ কলোনির ১ নম্বর ঝিল বরিশালঘোনা এলাকায় পাহাড়ধসে একই পরিবারের তিনজনের মৃত্যু হয়। এমন মৃত্যুও বাসিন্দাদের মধ্যে ভয় ধরাতে পারেনি। একই এলাকায় নির্বিঘ্নে বসবাস করছে আরও অনেকে।

গতকাল নগরের আকবরশাহ রেলওয়ে পাহাড়, ফিরোজশাহ কলোনি, মতিঝরনা এবং বাটালি হিল এলাকা ঘুরে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি দেখা গেছে। এসব এলাকার যেখানে আগে পাহাড়ধসে প্রাণহানি ঘটেছে, সেখানেই নতুন করে বসতি গড়ে উঠেছে। চট্টগ্রামে ৩০টি পাহাড়ে প্রায় ১০ হাজার মানুষ অতিঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবছর আমরা ওই বাসিন্দাদের বাঁচাতে কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু তাদের মধ্যে সচেতনতা নেই।’

পূর্ব ফিরোজশাহ বরিশালঘোনা এলাকায় গতকাল দেখা যায়, নূর মোহাম্মদের বিধ্বস্ত ঘরটির ভিটার ওপর বসে আছে নিহত নুরজাহান বেগমের দুই শিশু কন্যা এবং বোন শাহিনুর বেগম। পাশে বসা হাসি বেগম নামে এক ঘরমালিক বললেন, ‘আমাদের এখানে কোনো সময় পাহাড়ধস হবে না।’

২০১১ সালের ১ জুলাই প্রবল বৃষ্টির মধ্যে বাটালি হিলের প্রতিরোধ দেয়ালসহ ভূমিধসে ১৭ জন মারা যায়। ওই দেয়ালের পাশে এখনো ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে অন্তত ২০টি পরিবার। মো. সেলিম নামে এক বাসিন্দা বলেন, দেয়ালটি শক্তভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। এখন আর ভয় নেই।

২০১২ সালের ২৬ জুন চট্টগ্রামের আকবরশাহ মাজার এলাকায় পাহাড়ধসে ২৮ জন নিহত হয়। গতকাল ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়ের খাঁজে নতুন করে প্রায় অর্ধশত বসতি গড়ে উঠেছে। ঘরগুলোর সামনের সারিতে রয়েছে সারিবদ্ধ দোকান। ২০০৮ সালে মতিঝরনায় মারা যায় ১৪ জন। সেখানেও এখন শত শত ঝুঁকিপূর্ণ বসতি।

শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যসচিব জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পাহাড়ের বাসিন্দাদের একদিকে সরিয়ে নিলে অন্যদিকে গিয়ে আবার বসতি গড়ে। এবারও মাইকিং করা হয়েছে।

সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয় না

বর্ষা এলে উচ্ছেদের তোড়জোড় শুরু হয়। সেবা–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে বাসিন্দাদের ঝুঁকিতে বসবাসে নিরুৎসাহিত করা হয়। প্রতিবছর এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। এবারও পাহাড়ি এলাকায় মাইকিং করা হয়। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।

২০০৭ সালে পাহাড়ধসে ১২৭ জন নিহত হওয়ার পর গঠিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির বিভিন্ন সভায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের স্থায়ী ও অস্থায়ী পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এসব সিদ্ধান্ত আলোর মুখ দেখেনি। এর মধ্যে স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করে পাহাড়ে বনায়ন করার সিদ্ধান্ত ছিল অন্যতম।

রেলওয়ে, ওয়াসাসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার পাহাড়গুলো দখল করেছে ছিন্নমূল মানুষজন। পূর্ব ফিরোজশাহ ১ নম্বর ঝিল এলাকায় প্রায় ৫০০ পরিবার বসতি গড়ে তুলেছে। এই পাহাড়টি রেলওয়ের মালিকানাধীন। পাহাড়টি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেওয়া হয়।

এই পাহাড়ের অবৈধ বাসিন্দারা ১ নম্বর ঝিল বহুমুখী সমবায় সমিতি নামে একটি সংগঠন করেছে। ওই সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সাইনবোর্ডে নাম লেখা স্থানীয় আওয়ামী লীগদলীয় কাউন্সিলর জহিরুল আলম জসিম। জানতে চাইলে জসিম বলেন, ‘আমি আগে সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। এখন নেই। আমার কোনো জায়গাও নেই ওখানে।’

জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন বলেন, এটি বড় ধরনের সমস্যা। এ সমস্যার সঙ্গে সিডিএ, সিটি করপোরেশন, পুলিশ—সবাই জড়িত। সবার সম্মিলিত উদ্যোগে যদি একটি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নেওয়া যায় তাহলে সম্ভব। যাতে পাহাড়ে কোনো লোক থাকতে পারবে না।