জনপ্রিয়তা বাড়ছে সাইকেলের

তরুণদের মধ্যে সাইকেলের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। রাজধানীতে এখন প্রায়ই তাঁদের সাইকেল চালাতে দেখা যায়। গতকাল হাতিরঝিলে।  ছবি: প্রথম আলো
তরুণদের মধ্যে সাইকেলের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। রাজধানীতে এখন প্রায়ই তাঁদের সাইকেল চালাতে দেখা যায়। গতকাল হাতিরঝিলে। ছবি: প্রথম আলো

‘আগে নয়টার অফিস ধরার জন্য সকাল সাতটায় বাসা থেকে বের হতাম। বাসস্ট্যান্ডে এসে অপেক্ষা করতে হতো বাসের জন্য। বাস পেলেও পড়তে হতো যানজটে। সন্ধ্যায় আবার বাসায় ফেরার সময় ভিড় ঢেলে বাসে ওঠা। আবার বাসে ওঠার সময় চালকের সহকারীদের হাতে হেনস্তার ঘটনা তো অহরহ ঘটত। কিন্তু সাইকেল এসব ঝামেলা থেকে আমাকে মুক্তি দিয়েছে।’

ঢাকার রাস্তায় সাইকেল ব্যবহারের সুফল সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে এসব কথা বলেন বেসরকারি সংস্থার কর্মী ফারজানা ইসলাম। তাঁর কাছে সাইকেল ভোগান্তি এড়ানোর বাহন।

ফারজানা ইসলাম জানান, আগে মিরপুরের বাসা থেকে বনানীর অফিসে যেতে তাঁর দুই ঘণ্টা লাগত। এখন তিনি মাত্র এক ঘণ্টায় অফিসে
যেতে পারছেন।

ফারজানার মতো এখন রাজধানীতে অনেকেই যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছেন বাইসাইকেল। ঢাকার যানজট এড়াতে তাঁদের কাছে সাইকেল হয়ে উঠছে বিকল্প যান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক সংগঠন বিডি সাইক্লিস্টের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী শুধু ঢাকায় যাতায়াতের জন্য লক্ষাধিক মানুষ সাইকেল ব্যবহার করেন। বিডি সাইক্লিস্টের স্বেচ্ছাসেবক ফুয়াদ হোসেন বলেন, ব্যবহারকারীরা তাঁদের অবসর সময় কাটাতে, ঘুরতে ও দৈনিক কাজের জন্য সাইকেল ব্যবহার করেন।

পরিবেশবান্ধব বাহন হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাইকেলকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ডেনমার্কের কোপেনহেগেনের প্রায় অর্ধেক বাসিন্দা তাঁদের কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতের বাহন হিসেবে সাইকেল ব্যবহার করেন।

পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, লক্কড়ঝক্কড় যানবাহনের চেয়ে ঢাকার রাস্তায় সাইকেল হতে পারে যানজট নিরসন ও সময় বাঁচানোর ‘স্মার্ট’ সমাধান।

ঢাকার রাস্তায় বাইসাইকেল চালানোর অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা রায়হান মাসুদ বলেন, সাইকেল নিয়ে যেকোনো জায়গায় যাওয়া যায়। গন্তব্যেও পৌঁছানো যায় নির্ধারিত সময়ে। বাস, অটোরিকশা কিংবা লেগুনার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। অটোরিকশা ও রিকশার ভাড়া নিয়ে দর-কষাকষির ঝামেলা নেই। গন্তব্যে পৌঁছানোর আগে ইচ্ছা হলে কোথাও নেমে প্রয়োজনীয় কাজও সেরে নেওয়া যায়।

মাসুদ বলছিলেন, তাঁকে দেখে তাঁর আরও ছয়জন সহকর্মী এখন নিয়মিত সাইকেল চালিয়ে অফিসে যাতায়াত করেন। যানজটের শহরে সাইকেল এখন শুধু ফ্যাশন নয়, অর্থ ও সময় বাঁচানো এবং যাতায়াত গতিশীল করারও একটি মাধ্যম।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ সামছুল হক বলেন, একটি পরিকল্পিত নগরের সড়ক করা হয় গণপরিবহন, পথচারী ও মোটরসাইকেল অথবা সাইকেলের কথা মাথায় রেখে। কিন্তু ঢাকায় শুধু গণপরিবহন হিসেবে বাস আর পথচারীর কথা চিন্তা করে সড়ক তৈরি করা হয়েছে। এখানে অন্য কোনো পরিবহনের কথা ভাবা আগেও হয়নি, এখনো হচ্ছে না। একবিংশ শতাব্দীতে যখন বিকল্প বাহনের প্রসঙ্গ এসেছে, তখন সংশ্লিষ্টদের উচিত নতুন ঢাকা হিসেবে গড়ে ওঠা এলাকাগুলোতে এই সুবিধার কথা মাথায় রাখা।

ঢাকায় ২০১৪ সাল থেকে সাইকেল বিক্রি শুরু করে মেঘনা গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান সাইকেললাইফ এক্সক্লুসিভ। প্রতিষ্ঠানের সহকারী বিপণন ব্যবস্থাপক সৈয়দ হেলাল হোসেন জানান, শুধু গুলশান লিংক রোডে প্রতিষ্ঠানের প্রধান শাখা থেকে প্রতি মাসে গড়ে সাইকেল বিক্রি হয় প্রায় ১৫০টি। তিনি আরও বলেন, সাধারণত অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারিতে আবহাওয়া ভালো থাকে। তখন সাইকেল বেশি বিক্রি হয়। বেশির ভাগ ক্রেতাই অফিসগামী ও শিক্ষার্থী। এর মধ্যে নারী ক্রেতাও আছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক।

২০১০ সাল থেকে রাজধানীর সড়কে সাইকেল লেনের জন্য আন্দোলন চালিয়ে আসছে সাইকেল লেন বাস্তবায়ন পরিষদ নামের একটি সংগঠন। সংগঠনের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংগঠনের পক্ষ থেকে দুই সিটি করপোরেশন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো লেন চালু করা হয়নি, নেই সাইকেল পার্ক করার ব্যবস্থাও।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) কয়েকটি সড়কে দেশি-বিদেশি অর্থায়নে সাইকেল লেন করার প্রস্তুতি চলছে। এর মধ্যে মাইকেল ব্লুমবার্গ ফাউন্ডেশনের সহায়তায় গুলশান ও বনানীতে সাইকেল লেন করা হবে। নভেম্বরের দিকে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।

ডিএনসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এটি ছাড়াও নিজস্ব অর্থায়নে মিরপুরের জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভার (মিরপুর-এয়ারপোর্ট রোড) থেকে ডিওএইচএস পর্যন্ত লেন তৈরির কাজ চলছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) চলতি বার্ষিক কর্মপরিকল্পনায় সাইকেল লেন করার প্রস্তাব নেই। প্রধান প্রকৌশলী আলী আহমেদ বলেন, তবে ভবিষ্যতে সাইকেল লেন করার পরিকল্পনা আছে তাঁদের।