সম্পাদক পরিষদের প্রতিবাদে সমর্থন আরএসএফের

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংস্কারের দাবিতে দেশের সম্পাদক পরিষদের দৃঢ় অবস্থানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে তথ্য ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)। ফ্রান্সের প্যারিসভিত্তিক সংগঠনটি মঙ্গলবার নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা এক বিবৃতিতে এই সমর্থনের কথা জানায়।

জাতীয় সংসদে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলে গত সপ্তাহে স্বাক্ষর করেন রাষ্ট্রপতি। এর মাধ্যমে এটি আইনে পরিণত হয়। এই আইনে পুলিশকে পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়াসহ বেশ কিছু ধারা রয়েছে, যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করবে বলে উদ্বেগ জানিয়ে আসছেন সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা। এসব ধারা পরিবর্তনেরও দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। সর্বশেষ গতকাল সোমবার সম্পাদক পরিষদ রাজধানীতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আইনটির নয়টি ধারা সংশোধনের দাবিতে মানববন্ধন করে।

আরএসএফ-এর এশিয়া প্যাসিফিক ডেস্কের প্রধান ডেনিয়েল বাসটার্ড বলেন, ‘বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা একটি আইন, যার কয়েকটি ধারার মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তা পরিবর্তনের দাবিতে লড়াই করছেন, সেই লড়াইয়ে আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বর্তমানে যে অবস্থায় রয়েছে, তা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য বড় হুমকি। সাধারণ নির্বাচনের আর মাত্র দুই মাস বাকি। এই পরিস্থিতিতে আমরা সাংসদদের প্রতি নির্বাচনী প্রচারণার কেন্দ্রীয় ইস্যুতে পরিণত হওয়া আইনটি সংশোধনের আহ্বান জানাচ্ছি।’

জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সম্পাদক পরিষদের মানববন্ধন। ছবি: প্রথম আলো
জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সম্পাদক পরিষদের মানববন্ধন। ছবি: প্রথম আলো

আরএসএফের সংবাদমাধ্যমের বৈশ্বিক সূচক-২০১৮-এ ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৪৬তম অবস্থানে রয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ৯টি ধারা সংশোধনের দাবিতে সোমবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছে সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ।

মানববন্ধনে সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকে দাবিগুলো তুলে ধরেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম। মানববন্ধনে তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার আগ থেকেই এ আইনের বিভিন্ন ধারা নিয়ে সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ করে আসা হচ্ছিল। তাঁরা মনে করেন, আইনটি স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মুক্ত গণমাধ্যমের পরিপন্থী। সম্পাদক পরিষদ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরোধী নয়। পরিষদ আইনের বিশেষ কতগুলো ধারা সংশোধনের দাবি করছে। বর্তমান আইনটি শুধু সাইবার জগৎ নয়, স্বাধীন গণমাধ্যমেরও কণ্ঠরোধ করবে। তাঁরা চান, আগামী সংসদ অধিবেশনেই এই আইন সংশোধনের মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও স্বাধীন সাংবাদিকতা নিশ্চিত করা হবে।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সম্পাদক পরিষদের মানববন্ধন। ছবি: প্রথম আলো
জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সম্পাদক পরিষদের মানববন্ধন। ছবি: প্রথম আলো

মানববন্ধনে মাহ্‌ফুজ আনাম তাঁদের সাত দফা দাবি তুলে ধরেন। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ১. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাক্‌স্বাধীনতা সুরক্ষার লক্ষ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩ ধারাগুলো অবশ্যই যথাযথভাবে সংশোধন করতে হবে, ২. এসব সংশোধনী বর্তমান সংসদের শেষ অধিবেশনেই আনতে হবে, ৩. পুলিশ বা অন্য কোনো সংস্থার মাধ্যমে কোনো সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে তল্লাশি চালানোর ক্ষেত্রে তাদের শুধু নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু আটকে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে, তবে কোনো কম্পিউটার ব্যবস্থা বন্ধ করার অনুমতি দেওয়া যাবে না। শুধু তখনই প্রকাশের বিষয়বস্তু আটকাতে পারবে, যখন সংশ্লিষ্ট সংবাদ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করে কেন ওই বিষয়বস্তু আটকে দেওয়া উচিত, সেই বিষয়ে যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে পারবে, ৪. কোনো সংবাদমাধ্যমের কোনো কম্পিউটার ব্যবস্থা আটকে দেওয়া বা জব্দ করার ক্ষেত্রে অবশ্যই আদালতের আগাম নির্দেশ নিতে হবে, ৫. সংবাদমাধ্যমের পেশাজীবীদের সাংবাদিকতা দায়িত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপরাধের ক্ষেত্রে প্রথমেই আদালতে হাজির হওয়ার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে সমন জারি করতে হবে এবং সংবাদমাধ্যমের পেশাজীবীদের কোনো অবস্থাতেই পরোয়ানা ছাড়া ও যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ ছাড়া আটক বা গ্রেপ্তার করা যাবে না, ৬. সংবাদমাধ্যমের পেশাজীবীর দ্বারা সংগঠিত অপরাধের ক্ষেত্রে তাঁদের বিরুদ্ধেও মামলা দায়েরের গ্রহণযোগ্যতা আছে কি না, তার প্রাথমিক তদন্ত প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমে করতে হবে। ওই লক্ষ্যে প্রেস কাউন্সিলকে যথাযথভাবে শক্তিশালী করা যেতে পরে এবং ৭. এই সরকারের পাস করা তথ্য অধিকার আইন দ্ব্যর্থহীনভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ওপর প্রাধান্য দেওয়া উচিত। এই আইনে নাগরিক ও সংবাদমাধ্যমের জন্য যেসব স্বাধীনতা ও অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, সেগুলোর সুরক্ষা অত্যাবশ্যকভাবে করতে হবে।

মানববন্ধনে দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রের সম্পাদকেরা অংশ নেন। মানববন্ধনে সম্পাদকদের মধ্যে ছিলেন মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, নিউ এজের সম্পাদক নুরুল কবির, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মনিরুজ্জামান, ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম, কালের কণ্ঠের সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম, করতোয়ার সম্পাদক মো. মোজাম্মেল হক, ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শহীদুজ্জামান খান, ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান, সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি, বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, ইন্ডিপেনডেন্টের সম্পাদক এম শামসুর রহমান প্রমুখ।

আরও পড়ুন