ভোটের রাজনীতি 'জোটবন্দী'

>

• নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে জোটের আবর্তে
• এখন মাঠে অন্তত ১৪টি জোটের নাম পাওয়া গেছে
• বেশির ভাগ জোট হয়েছে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে
• অনেক ছোট এবং নামসর্বস্ব দলও এখন গুরুত্ব পাচ্ছে
• জোটবন্দী রাজনীতির প্রবণতা শুরু হয় ২০০১ সাল থেকে

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর আড়াই মাসের কম। প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করা বা মাঠের প্রস্তুতির চেয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মনোযোগ এখনো জোট–মহাজোটের প্রতি। চলছে এক জোট ভেঙে অন্য জোটে ভেড়ানোর তৎপরতাও। ডানপন্থী, বামপন্থী, মধ্যপন্থী এবং বড়–ছোট বা নামসর্বস্ব সব দলই এই দৌড়ে শামিল হয়েছে। কোনো দলই আর এককভাবে ভোটে নামতে চাইছে না।

জোট নিয়ে এই দৌড়ঝাঁপের কারণে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কোন দলের সঙ্গে কত আসন নিয়ে সমঝোতা করবে, তা এখনো স্পষ্ট হয়নি। জোটের সমীকরণে বড় দলগুলোর অনেক বড় নেতা বা একাধিকবার নির্বাচিত সাংসদও নিজের মনোনয়নপ্রাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছেন। এককথায় পুরো ভোটের রাজনীতিই এখন জোটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই জোটের রাজনীতির কারণে অনেক ছোট বা নামসর্বস্ব দলও এখন গুরুত্ব পাচ্ছে।

এখন মাঠে অন্তত ১৪টি জোটের নাম পাওয়া গেছে, যাতে দলের সংখ্যা ১৯৩। এর মধ্যে নিবন্ধিত দল কেবল ৩৯ টি। আবার একই দল সমমনা একাধিক জোটেও আছে।

সর্বশেষ বিএনপি, গণফোরাম, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) ও নাগরিক ঐক্য মিলে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। শেষ মুহূর্তে সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারাকে ছাড়াই জোটের ঘোষণা আসায় আরেকটি জোট যুক্তফ্রন্ট অনেকটা অকার্যকর হয়ে পড়ে। কারণ, এই জোটের বাকি সবাই ঐক্যফ্রন্টে চলে গেছে। তবে গতকাল ২০–দলীয় জোট থেকে যে দুটি ছোট দল বেরিয়ে গেছে, তাদের একটি বি চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টে, অপরটি সরকারি জোটে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০–দলীয় জোট এরই মধ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে স্বাগত জানিয়েছে। বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সরকারবিরোধী দলগুলোকে একটা ছাতার নিচে আনতে চাচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও জোটের রাজনীতিতে পাল্টা কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোট মিত্র বাড়ানোর চেষ্টা করছে। বিএনপির ভোটে আসাটা নিশ্চিত হলে এরশাদের জাতীয় পার্টিকে নিয়ে ২০০৮ সালের মতো মহাজোটও হতে পারে। এর বাইরে বর্তমান সরকারঘনিষ্ঠ বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমানের ও তরীকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব আবদুল আউয়ালের নেতৃত্বে সম্প্রতি ধর্মভিত্তিক নতুন জোট হয়েছে। নাম ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স। এতে ১৪টি দল আছে, যার একটিও নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত নয়। এই জোটও আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকবে।

আবার, জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন নিয়ে দর–কষাকষির প্রস্তুতি নিলেও এরশাদ নিজে আলাদা একটি জোট গঠন করেছে। নাম সম্মিলিত জাতীয় জোট। এর মধ্যে যে ৫৮টি দল আছে, তার মধ্যে জাতীয় পার্টিসহ দুটি দল নিবন্ধিত। বাকিগুলো নামসর্বস্ব।

দুর্নীতির মামলায় সাজা মাথায় নিয়ে বাইরে থাকা বিএনপির সাবেক নেতা নাজমুল হুদা ৩৪–দলীয় জোট করেছে। যার একটিও নিবন্ধিত নয়। বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট অ্যালায়েন্স (বিএনএ) নামের এই জোটও বর্তমান ক্ষমতাসীন জোটে যুক্ত হওয়ার চেষ্টায় আছে। গত নির্বাচনে ঢাকা–১৭ আসন (গুলশান–ক্যান্টনমেন্ট) থেকে নির্বাচিত আবুল কালাম আজাদেরও একটি জোট আছে, নাম বিএনএফ। এটিও বর্তমান সরকারপন্থী।

একসময় দেশে ছিল দল ভাঙার রাজনীতি। মূলত জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর এটা শুরু। এরপর এরশাদের শাসনামলে সেটা আরও বাড়ে। কোনো নীতি, আদর্শ নয়, মূলত ব্যক্তিগত লাভ ও ক্ষমতায় যাওয়ার আশায় তখন অনেক রাজনৈতিক নেতা ও দল সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এক দল থেকে অন্য দলে বা দল ভেঙে একই নামে নতুন দল করেছিল। জোটবন্দী রাজনীতির প্রবণতা শুরু হয় ২০০১ সাল থেকে।

২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে। তখন আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচন করেছিল। ২০০৫ সালে আওয়ামী লীগ ১৪–দলীয় জোট করে। ২০০৮ সালে ১৪ দলের সঙ্গে জাতীয় পার্টিসহ মহাজোট করে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে জয়ী হয়। তারপর বিএনপি সংকটে পড়ে যায়। এরপর বিএনপি ২০১২ সালে ১৮–দলীয় জোট গঠন করে, যা পরে ২০ দলে পরিণত হয়।

ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম একসময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটে ছিল। পরে বেরিয়ে যায়। যুক্ত হয় তরীকত ফেডারেশন ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জেপি)। এই জোটের শরিক জাসদ গত বছর ভেঙে দুই ভাগ হয়। দুই ভাগই ১৪ দলে আছে।

আবার, এক-এগারোর পটপরিবর্তনের আগে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করেছিল বি চৌধুরীর বিকল্পধারা ও অলি আহমদের এলডিপি। পরে অবশ্য এলডিপি বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেয়। এই দুটি দলকে আগামী নির্বাচনেও পাশে পেতে তৎপর আওয়ামী লীগ

কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ গত নির্বাচন বর্জন এবং বর্তমান সরকারের বিরোধিতা করে নানা কর্মসূচি পালন করে। কিন্তু এখন দলটি আওয়ামী লীগের জোটে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ছোট ও নামসর্বস্ব শখানেক দলের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে। কিছু কিছু দলকে নামকাওয়াস্তে রাখা হবে, যাতে প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ৭০টি আসন শরিকদের জন্য রাখার কথা ভাবছে।

১৪ দলের মুখপাত্র ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, কিছু জোট অহেতুক হয়েছে। কোনোরকমে ক্ষমতার অংশীদার হতেই এই তৎপরতা। তিনি দাবি করেন, ১৪–দলীয় জোট আদর্শিক জোট।

গত জুলাই মাসে বামপন্থী আটটি দল নিয়ে একটি জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। নাম দেওয়া হয় ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’। লক্ষ্য বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বাইরে তৃতীয় শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা। এই জোটে আছে সিপিবি, বাসদ, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্ক্সবাদী), গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি সিপিবি কার্যালয়ে গিয়ে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন। অন্যদিকে বিএনপি চাইছে, তাদের সঙ্গে না এলেও বাম জোট যেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে না ভেড়ে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জোট-মহাজোটের ধারণাকে তাঁরা ইতিবাচকভাবেই দেখেন। কারণ, এর মাধ্যমে বহুমতের উপস্থিতি থাকে। আর ভাঙা-গড়া রাজনীতিরই অংশ বলে মনে করেন তিনি।

নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে, ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৭৫টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলে ২ হাজার ৩৬৩ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন চালু হয়। তখন অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৩৮ টিতে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ৫৬৭ জন। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে নিবন্ধিত ১২টি দল অংশ নেয়। প্রার্থী ছিলেন মাত্র ৫৪৩ জন। অবশ্য এই নির্বাচনে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।

এখন যে ১৪টি জোটের নাম পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ১২টি হয়েছে পাঁচ বছরে। এরই মধ্যে দফায় দফায় এসব জোটে ভাঙনও হয়েছে। জোটে থাকা দলগুলোর বেশির ভাগই নাম বা প্যাডসর্বস্ব। তাই অনেক সময় শরিক দলের সংখ্যা কত, কোনটার নেতা কে; তা জোটের নেতারাই বলতে পারেন না। এমনও জোট আছে, যার অন্তর্ভুক্ত কোনো দলেরই নিবন্ধন নেই।

ভোটের সময় এসব ছোট দলেরও কদর বাড়ে। অনেকে মনে করেন, বড় দলে মনোনয়ন পাওয়া কঠিন। তাই বড় জোটে থাকা ছোট দলে মনোনয়ন পাওয়া সহজ। ছোট দলের ভাগে পড়া আসনের বিষয়ে অনেকেরই নজর থাকে।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে বড়জোর পাঁচটি দলের নিজ শক্তিতে জয়ী হওয়ার ক্ষমতা আছে। জোট-মহাজোটে দলের সংখ্যা মনস্তাত্ত্বিক খেলামাত্র। এর মাধ্যমে রাজনীতির গুণগত কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। তিনি বলেন, একাধিক মত ও পথের দল সংসদে গিয়ে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরতে পারলে লাভ হতো। কিন্তু সে রকম পরিস্থিতি নেই।